Header Ads


 

বুরুলুকুই - পরিতোষ মাহাত

 

বুরুলুকুই
পরিতোষ মাহাত



[এই গল্পটি বছর দশেক আগে লেখা হলেও গোপীবল্লভপুর থেকে ‘বনমঞ্জরী’ পত্রিকায় ২৭ জানুয়ারি ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এখনও যারা ফেসবুক ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন – “কম নম্বর পেয়েও দাদু কাস্ট কোটায় WBCS/ বাবাও একইভাবে ডাক্তারনাতি কাস্ট কোটায় ডাক্তারি পড়ছেতিন জেনারেশনই কি অনগ্রসর?” – তাঁদের সম্মান রক্ষার্থে এই গল্পটি আন্তর্জালিক মাধ্যমে দেওয়া হল]

বেশ কয়েকদিন ধরেই ব্যাপারটা নজরে পড়েছে সীমার। ক্লাসের শেষ প্রান্তের এক কোণায় বসে থাকছে সে। সে মানে বুরুলুকুই। বুরুলুকুই মান্ডি। পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম মহুলবনিতে বাড়ি। সিধো-কানহু হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী। সীমার সহপাঠিনী। পড়াশুনায় খুব ভাল। যে কোন ব্যাপারেই তার অদম্য উৎসাহ। পড়াশুনা, খেলাধূলা, নাচ-গান; যেকোন বিষয়েই উৎসাহের ঘাটতি নেই। গান, বিশেষত সাঁওতালি গান অর্থাৎ সেরেঞ -এ তার অনায়াস দখল স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি অনিবার্য করে তোলেঅথচ সেই মেয়ে কিনা পিছতে পিছোতে শেষ প্রান্তে ! সীমার কাছে বিষয়টা বেশ অস্বাভাবিক লাগে।এমনটা তো সে কখনই দেখেনি। বরাবর খোলামেলা মনের মানুষ হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়ে বুরুলুকুইয়ের এ ব্যাপারটা তো জানতে হয়।

সীমার মনে কৌতূহল দেখা দিলেও একটা কিন্তু ভাব থেকে যায়। কেননা, সীমার সঙ্গে তার তেমন কথাবার্তা হয় না। ক্লাসে বরাবর পড়ে এই পর্যন্তই। বাড়িতেও একটা বিধিনিষেধ মা -বাবার কাছে শুনে এসেছে বরাবর। ওদের সঙ্গে স্কুলের ক্লাসে মােটেই মেলামেশা করবি না। আর বন্ধুত্ব ? ভুলেও ও পথে পা বাড়াবি না। ওরা গরীব। ওরা জংলী জাত। ওরা ভীষণ জেদী আর একরোখা। ওরা ভাল না। ওদের সঙ্গে কথা না বলাই ভালপ্রথম থেকেই সীমার মনে ওদের থেকে মানে বুরুলুকুই মান্ডি, আলোমণি মুরমু, মালা হেম্বরমদের একটা কেমন যেন বৈষম্যজনিত দূরত্বে ফেলে রেখেছে সীমা। ক্লাসের অন্যান্যদের সঙ্গে ওদের মোটামুটি বন্ধুত্ব হলেও সীমা কখনো ও পথে পা বাড়ায়নি। কোনদিন ওদের সঙ্গে এক বেঞ্চে বসেনি। কখনো তাদের প্রয়োজনে পড়াশুনা বা কোন বিষয় নিয়ে ওরা দৈবাৎ কখনো সীমার সাহায্য চাইলে সে দায়সারা ভাবে তাদের কথার উত্তর দিয়েছে। এছাড়া আর সীমা কী-ই বা করতে পারে? কেননা সে হল ক্লাসের ফাস্ট। ক্লাস ফাইভ থেকে এই স্কুলে তাদের ক্লাসের সে সেরা ছাত্রী। আর এ কারণেই হয়তো বা সীমার সঙ্গে তারাও দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কোন কোন বান্ধবীর মুখে শুনেছে ক্লাসের কোন কোন বন্ধুরা আড়ালে তাকে ‘লিমিটেড' নাম দিয়েছে। কারা দিয়েছে সেটা বুঝতে সীমার অসুবিধা হয় না। কিন্তু কেন দিয়েছে সেটা ভাবতে গিয়ে তার খুব রাগ হয়েছে। বিষেশত ক্লাসের সেই সমস্ত ছেলে সহপাঠীরা যারা হাজার চেষ্টা করেও সীমার সেরার জায়গাটা কেড়ে নিতে পারেনি। আড়ালে নাকি তারা বলে বেড়ায়- আরে তোরা তো মেয়ে। এখানে যতই বাহাদুরি দেখা- তোদের জন্যে তো সেই হাতা খুন্তি হাঁড়ি কুঁড়ির হেশেল পড়ে আছে। ওখানেই সব শেষ! সীমা বেশ বুঝতে পারে এটা আসলে প্রথম স্থান দখলের লড়াইয়ে হেরে যাওয়া কিছু ছাত্রের মানসিক হতাশার প্রতিফলন। জাস্ট জেলাসি! ঈর্ষা! হ্যা, ঠিক ঈর্যা কিংবা হতে পারে হিংসাও। সীমা মনে মনে রেগে গেলেও তার সে অভিব্যক্তি সে প্রকায় করে না। তার লক্ষে সে অবিচল থাকে।

ঈর্ষা সেও করেছে। হিংসা তারও হয়েছে। কিন্তু সে বুঝতে দেয়নি কাউকে। যেমন- সেবার স্কুলে বাংলার নতুন স্যার বসন্তবাবু যখন এলেন তখন প্রথম ক্লাসে এসেই সবার নাম ধাম জানতে চাইলেন। বেশ উজ্জ্বল রং। সুন্দর কথাবার্তা। প্রথমটায় সীমার খুব ভাল লেগেছিল। কিন্তু যখন তোমার স্কুল জীবন নিয়ে কিছু লিখতে বললেন আর সেই লেখাগুলো পড়তে গিয়ে বুরুলুকুইয়ের সুন্দর হাতেরলেখার প্রশংসা করলেন, তখন সীমার মনেও ঈর্ষা জেগেছিল। সীমা ক্লাসর ফার্স্ট গার্ল অথচ তার হাতের লেখা নিয়ে একটা শব্দও খরচ করলেন না। স্যার কেমন মানুষ! কেমন যেন এক রাগে সীমা মাথা নিচু করে বসেছিল। প্রথম দর্শনে স্যারের প্রতি জেগে ওঠা ভাল লাগার ভাবটা উবে গিয়েছিল। আর ওদের সঙ্গে বিশেষত বুরুকুইয়ের সঙ্গে সীমা দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছিল হাজার মাইল। পরবর্তী দিনগুলোতেও দেখা গেল বসন্ত স্যার আদিবাসী ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি কেমন যেন বেশি বেশি করে যত্ন নিচ্ছেন। তাদের পড়া ধরছেন। লেখা সংশোধন করে দিচ্ছেন। বেশি বেশি পাত্তা দিচ্ছেন। সীমার এটা বেশ অপছন্দের। কেননা, তারা বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ করতে পারে না, লিখতে গিয়েও অনেক সমস্যা - বাক্য গঠনে বা যথাযথ শব্দ প্রয়োগে। হাতের লেখাটাই যা সুন্দর। অথচ স্যারের যত মনোযোগ, যত দরদ গিয়ে তাদের ওপরেই পড়ে। ফার্স্ট গার্ল সীমাকে নিয়ে স্যারের কোন মাথা ব্যথাই নেই।

বুরুলুকুই সেদিন কি একটা পড়া বলতে না পারায় প্রচন্ড রেগে গেলেন বসন্ত স্যার। স্যারের এই রূপের সঙ্গে পরিচিত নয় কেউ। সবাই খুব অবাক হয়ে গেল! উত্তেজিত ভাবে স্যার বকে চলেছেন বুলুকুইকে। স্যারের টুকটুকে ফর্সা মুখখানা একটা লাল আভায় ছেয়ে গেল। সবাই চমকে গেছে। সীমাও। তার খুব ভয়ও করছে। খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন। যে কেউ উত্তর দিতে পারত। বুরুলুকুই তো পারতই। অথচ সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলমাথা নিচু করে। স্যার সমানে বকে চলেছেন এই সামান্য প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে; -“বেশ কয়েকদিন ধরেই দেখেছি ক্লাসে মনোযোগ নেই। এত করে বোঝালাম। অথচ আজ উত্তর নেই। কিস্যু হবে না তোদের দিয়ে। মুখে কুলুপ এঁটে থাকলে কিস্যু হয় না। হ্যাঁ বা না কিছু একটা তো বলবি। ফাকিবাজি চলবে না, বুঝতে পেরেছিস ? বুঝেছিস কিছু ?.. নাহ, মেয়েটি পাথর হয়ে গেছে! নিশ্চল নিশ্চুপ পাথরের মত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোন কথাই বেরুল না তার মুখ থেকে। স্যার বসতে বললেন। সে ধীরে ধীরে বসল। বসে রইল মাথা নিচু করে। সীমা বসন্ত স্যারের থেকেও বেশি দিন ধরে বুরুলুকুইকে চেনে, জানে। তার স্বভাব তো এরকম নয়। সীমা যথেষ্ট বিস্মিত হল। মেয়েটি তাহলে পড়াশুনা করতে পারছে না। কিংবা পড়ছে না। কিন্তু এরকম তো হয় না! হয়নি কোনদিন।

টিফিনের সময় একটি মেয়ে এসে সীমাকে বলল যে বসন্ত স্যার তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। সীমা কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। হাত মুখ ধুয়ে এসে সবে সে টিফিনের কৌটো খুলে খেতে বসেছিল। কৌটো খুলে খেতে বসেছিল। কৌটো বন্ধ করে সে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু বুরুলুকুইয়ের পড়া না পারার সঙ্গে সীমার সম্পর্ক বা যোগসূত্র কোথায়, না কি অন্য কোন কারণে স্যার ডেকেছেন ভেবে কুল কিনারা পেল না সীমা। ধীরে ধীরে সে সস্টাফ রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখেই বসন্তু স্যার বেরিয়ে এলেন।

বললেন ‘সীমা। শোন কথা আছে! সীমা বলল, হ্যাঁ স্যার, বলুন। স্যার বললেন,- বুরুলুকুইকে দেখছিস তো দিন দিন ফঁকিবাজিতে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। আমার মনে হচ্ছে ও কোন বড় সমস্যায় পড়েছে। সীমা চুপ করে স্যারের কথা শোনে। স্যার বলে চলেন, তোকে একটা কাজ করতে হবে। ও তোর ক্লাসের বন্ধু। তুই ক্লাসের সেরা ছাত্রী। তুই যদি কথা বলে জানাতে পারিস তো ভাল হয়। তাড়াহুড়োর দরকার নেই। তবে বেশি দেরী করা উচিত হবে না। মোটকথা, সময়-সুযোগ বুঝে ওর সঙ্গে কথা বলে ওর সমস্যাটা কি তা জানতে হবে। আমাদের তো ও সব কিছু বলবে বলে মনে হয় না। একমাত্র তুই-ই পারবি এটা করতে। কিন্তু মনে রাখিস, ও যেন বুঝতে না পারে যে আমি এটা তোকে খোঁজ-খবর নিতে বলেছি।

সীমা বলে, কিন্তু স্যার...

স্যার বলেন, - কোন কিন্তু নয় তুই পারবি। আমি জানি তুই কথা বললেও না করতে পারবে না।

স্যারের নির্দেশের আড়ালে কেমন যেন অনুরোধের সুর ছুঁয়ে আছে। ভাল লাগল সীমার। স্যার যেন একমাত্র তার উপরেই ভরসা করতে পারেন এই সমস্যার সমাধানে। এটা জেনে এখটা অদ্ভুত অনুভূতি হল সীমার। সে মাথা নেড়ে বলল,- ঠিক আছে স্যার। চেষ্টা করব।

-ব্যাস এই তো চাই। পড়াশোনায় ভাল একটি ছাত্রী এমন করে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কেন এটা জানা দরকার। আমি অন্যান্য স্যার ম্যাডামদের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম। কোন ক্লাসেই ও ঠিকঠাক পড়া করছে না। রেসপন্স করছে না। ব্যাপারটা সবারই নজরে এসেছে। সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। এখন এরকম একদম ঠিক নয়। তুই একটু খোঁজ খবর নে।

টিফিনের সময় ছেলে মেয়েরা প্রায় কেউই ক্লাসে থাকে না। ক্লাস রুমের বাইরে বেরিয়ে পড়ে। হৈ চৈ আর ছুটোছুটি করে। সীমা এসে ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা বের করল পেছনের বেঞ্চে কোণায় তাকিয়ে দেখল বুরুলুকুই বসে আছে মাথা নামিয়ে। আর আলোমণি ও মালা তার পাশে বসে কিছু একটা বলে চলেছে। সীমা টিফিন বক্সটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে তাদের কাছে গেল। মনের মধ্যে যদিও বাবা-মার বিধি-নিষেধের কথা মনে পড়ছিল। তাই একটু অস্বস্তিও হচ্ছিল তার। কিন্তু স্যারের কথাও সে কিছুতেই ফেলে দিতে পারবে না। সীমা বলল, কী ব্যাপার। তোরা টিফিন করবি না ? এখনও বসে আছিস ? মালা বলল, “সেটাই তো বলছি! বুরু কোন কথাই শুনছে না। খালি চুপচাপ বসে আছে। সীমা বলল, “ঠিক আছে, তোরা চল। আমি দেখছি। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর সীমা বুলুবুইয়ের পিঠে হাত আলতোভাবে ছুঁইয়ে বলল, “টিফিন খেয়েছিস? বুরুলুকুই কোন কথা না বলে মাথা নাড়ল। সীমা তার পাশে বসে বলল, না বললে তো হবে না। এই দ্যাখ, আমারও খাওয়া হয়নি। চল খাই। একি- জানালার বাইরে তাকাচ্ছিস কেন ? আমি এখানে। এদিকে আমার দিকে তাকা একবার। মুখ তুলে ফিরে তাকাল বুরুলুকুই। সীমা দেখল দু’গাল বেয়ে চোখের জলের ঝর্ণা অবিরল ঝরে পড়ছে।

সেদিন স্কুল ছুটির পর সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর সীমা স্টাফ রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল। বসন্ত স্যার বেরিয়ে বললেন, - ‘কিছু বলবি ? ‘হ্যা স্যার; - খারাপ খবর!’ সীমা বলল। “মানে?” – স্যার জানতে চাইলেন। সীমা সব বলল ‘স্যার, বুরুলুকুই ভেঙে পড়েছে। বাড়িতে ওর বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করে ফেলেছে। ওর মা-বাবা গরীব। ছেলে নাকি কোন খাদানে কাজ করে। বুরু বলছে যে তার আর পড়া হবে না। তার অনেক পড়াশুনার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সব স্বপ্ন, আশা একেবারে শেষ হয়ে গেছেস্যার অবাক হয়ে বললেন ‘সেকি! ও তার বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেনি ? ‘অনেক চেষ্টা করেছে স্যার! কিন্তু তাদের এক কথা। মেয়ে দশ ক্লাস পড়েছে। আর পড়ানোর সামর্থ্য নেই। অনেক কষ্টে তারা এতদূর পড়িয়েছে। এখন মেয়ে বিয়ের যোগ্য হয়েছে। যোগ্য পাত্রের খোঁজ পেয়েছে। পাত্রপক্ষেরও খুব পছন্দ হয়েছে। তারাও ছাড়তে নারাজ। মেয়েটি খুবই কান্নাকাটি করছে ! বলছে, আর সে স্কুলে আসতে পারবে না। মাধ্যমিকও সে দিতে পারবে না। কি করা যায় স্যার?’ ‘আহা রে! স্যারের স্বরে কেমন মমতা মাখানো অভিব্যক্তি। স্যার বললেন “আচ্ছা তুই যা, আমরা দেখছি কি করা যায়।” সীমা তার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। যেতে যেতে পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে দেখল বসন্ত স্যার তার সাইকেলে চড়ে পেছনের বামদিকের এবড়ো খেবড়ো উঁচু নিচু মোরাম রাস্তা দিয়ে দ্রুত পাহাড় ধারের সাঁওতাল পাড়ার দিকে এগিয়ে চলেছেন। পুরোনো দিনের বেশ কিছু মহুয়া গাছ নীল আকাশে মাথা তুলে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে স্যারকে স্বাগত জানাচ্ছে। বিকেলের পড়ন্ত আলো দূর পাহাড়ের চূডড়োগুলো রাঙিয়ে দিচ্ছে।

প্রায় বারো বছর পরের ঘটনা। উচ্চ শিক্ষার সমস্ত ডিগ্রি অর্জনের পারে সীমা এখন একটি শহরের নামকরা স্কুলের শিকিল। বছর দুয়েক হল স্কুল সার্ভিস কমিশনের সব রকমের পরীক্ষায় পাস করে চাকরিটা পেয়েছে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে খুব ভালবাসে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে সম্পর্কটাও বেশ সুন্দর। আজ হেড মাস্টার মশায় স্টাফরুমে এসে বললেন –‘একটা সুখবর আছে! আমাদের বাংলার যে পোস্টটি খালি ছিল, সার্ভিস কমিশনের একজন টিচার ঐ পদে যোগদান করতে এসেছেন। উনি আপাতত আমার রুমে বসে আছেন। জয়েনিং-এর জন্য সেক্রেটারি মশাইকে ডাকা হয়েছে। উনি একটু পরেই এসে যাবেন। যাইহোক টিফিনের সময় স্টাফ রুমে নতুন টিচারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব সীমা দিদিমনি পর পর চারটে ক্লাসের পর টিফিনের বেল পড়তে স্টাফ রুমে এসেই দুদুটো মুখ দেখে আনন্দে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন! এক ঝলক দেখেই মনে হল কত চেনা – অথচ মনে হচ্ছে চেনা নয়। পরিষ্কারভাবে চিনতে গিয়ে মাঝখানের বারটা বছরের স্মৃতির ধূলো ঝাড়তে লাগলেন সীমা দিদিমণি। স্যার, আপনি! এখানে! ভাল আছেন তো?’ স্টাফ রুমের সবাইকে চমকে দিয়ে পায়ের ধূলো নিতে নিতে সীমা দিদিমণি বললেন। “হ্যাঁ, কিন্তু,…” মধ্য বয়সী মানুষটি বললেন।

‘স্যার চিনতে পারছেন, - আমি সীমা সেই সীমা আপনার ছাত্রী স্যার!মোটা ফ্রেমের চশমাটা একবার ঠিক করে নিয়ে তিনি বললেন, আপনি মানে তুমি সীমা! আরে কতদিন দেখিনি। তুমি এখানে আছো? কতদিন হল ? ভাল আছো তো?’ ‘হ্যাঁ স্যার ভাল আছি। দু’বছর হতে চলল এখানে আছি। আপনার খবর কি?’ ‘আমি তো বেশ ভালই আছি। তা বেশ ভালই হল। তোমার স্কুলে -এ একে চিনতে পারছ কিরে ভাল করে দেখ - তোমার স্কুলে বাংলার পোস্টে আজ জয়েন করল! সীমা দিদিমনি বসন্ত স্যারের সঙ্গে থাকা নতুন শিক্ষিকার দিকে এবার ভাল করে দেখলেন। দেখেই বলে উঠলেন ‘একি তুই! আরে - ! জাস্ট ভাবতেই পারছি না!’ অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে বুরুলুকুইয়ের হাত ধরলেন সীমা দিদিমণি! তার জীবনে এমন অপূর্ণ আনন্দানুভূতি এই প্রথম বার দেখা গেল! সীমাকে পেয়ে বুরুলুকুইও খুব খুশী। তোমরা দুজনেই ভাল থেকো। সুখে থেকো। আমাকে আবার পুরুলিয়ার গাড়ি ধরতে হবে। হাতে বেশি সময় নেই। সীমা, - বুরুলুকুই কথার মানে জানো তো? বুরু মানে পাহাড় আর লুকুই মানে ঝর্ণা। - পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এরকম অনেক প্রাণোচ্ছল পাহাড়ী ঝর্ণা আছে। তাদের ডাকেই আবার যেতে হবে আমাকে। জীবনের গোলোকধাঁধায় আঁধার পথে হারিয়ে যাওয়ার আগেই তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার আলোয় পৌঁছে দিতে হবে। হেড মাস্টার মশায় বলে উঠলেন, - ‘সে তো নিশ্চয়ই স্যার! আপনার কর্মযজ্ঞে আমাদের শুভেচ্ছা সব সময়ই থাকবে। তবে একটা অনুরোধ অল্প বয়সী নাবালিকা মেয়েদের বিয়ের প্রতিবাদে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে যে মেয়েটি আজ আপনার সাহচর্যে ও অনুপ্রেরণায় দৃষ্টান্ত হয়েছিল আর তার জন্যে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিল তাকে আমরা আজ আমাদের স্কুলের সহকর্মী হিসেবে পেলামতার জন্যে একটু মিষ্টিমুখ হয়ে যাক।

----------------------------

 

-

 

 

 

 

 

 

 

 

No comments

Powered by Blogger.