Header Ads


 

করমে বাঁচি সরমে নাচি - সমীর মাহাত


করমে বাঁচি সরমে নাচি
সমীর মাহাত






করম পরব লইজকালেই গুন গুনোট হয় গাঁ কে গাঁ, "হামি যাবই বাপের ঘরে, জাওয়া পরব বাঁদনা মকরে।" বা, "আইজ রে করম ঠাকুর ঘরে দুয়ারে, কাইল রে করম ঠাকুর সাঁক লদীর পারে।" এই জাওয়া - করম পরব কি! সভ্যতা সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে আদি জনজাতি কুড়মিরা কেন প্রাণপণে এখনও তার ধারক বাহক! আমাদের চৌদ্দ পুরুষদের আমল থে‌কে করম পালন করে আসা থেকেই এই নিবন্ধের পুরোটা। সোস্যাল মিডিয়ার ছয়লাপি উপস্থাপন, দোতলা জানালায় হুলকে তথ্য নিয়ে "গবেষক" সাজা সে নিয়ে মোটেই মন সন্তুষ্ট নয়, গোটায় নিজস্ব ভাবনা ছুঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা মাত্র।

গোটা করম পরবকে জাওয়া, ডালপুজা ও করম কহনির শপথ পাঠ, পাহ্না ও ডালি গাড়া এই মূল পর্ব গুলিতে ভাগ করা যেতে পারে। ভাদর মাসের শুক্ল পক্ষের যে একাদশী ওই দিনই করম ডাল পুজা হয় এতকাল। তার ৭/৯ দিন আগে দেওয়া হয় জাওয়া।

জাওয়াঃ - 

কচিকাঁচা মেয়েরা খাল বা নদী থেকে স্নান করে ভেজা কাপড়ে নতুন ছাকনা বা ডালায় বালি ছেঁকে জনার, ধান সুতরিসন, বিরহি প্রভৃতি শষ্য বীজকে তাতে অঙ্কুরিত হতে দেয়। প্রতিদিন বিকেলে মন্ডটিকে কারও উঠোনে রেখে বেড়া জাওয়া গীত করে তারা। মা, মাসি ,পিসিরা এক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করে। জাওয়া গীত  দু’ধরনের, বেড়া জাওয়া গীত পৃথিবীতে প্রথম অমিত্রাক্ষর ১৪ মাত্রাকে স্থাপিত করেছে,-

"অকালে।পুসিলি।পাখি।দুধু।ভাতু।দিঁঞে=১৪

আইজ।পাখি। তুঁই।হামায়।ফাঁকি।দিলি।=১৪

    বা,

"জাওয়া।দিলি।তরা।হলৈদ।কুথা।পালি=১৪

দকানিকে।নাম।দিব।হলৈদ।বেপারি=১৪

এ রকম বহু প্রচলিত গীত রয়েছে। ভাবনীয় অবশ্যই, আমাদের পূর্বাপুরুষদের পান্ডিত্য কত গভীর ছিল। ১৪ মাত্রার অমিত্রাক্ষর ছন্দের আবিষ্কারকের দাবিদার যেই হোন না কেন, প্রমাণ দিচ্ছি, তিনি জাওয়া গীতের নকলি করা লোক। এই পরবে বাপের বাড়িতে আসা মেয়েরা, বহুড়ি, ঝিউড়ি সবাই জড়ো হয়ে গ্রামের নির্জনে জাওয়া নাচ গীত করে। এই গীতের পৃথক ও নিজস্ব সুর আছে, তবে এগুলি অমিত্রাক্ষর। এই পর্বের নিট গুরুত্ব পাওয়া গেল, জল আলা বাতাস ছাড়া বীজের অঙ্কুরোদ্গম হয়না, আমাদের কচিকাঁচারা বিজ্ঞানের উদ্ভিদ বিদ্যার আবিষ্কারের বহু আগেই হাতে নাতে তা শিখেছে। 

ডালপুজাঃ

করম নামের বৃক্ষ আছে। গ্রামবাসীরা লায়াকে নতুন বস্ত্র পরিয়ে, স্থান বিশেষে কাঁধে চাপিয়ে, বাদ্যযন্ত্র সহ করম সম্পর্কিত ডহরিয়া গান গেয়ে ডাল কাটতে যায়। সেখানে করম ডোর, ঘাস দিয়ে দুধরনের বানিয়ে, সরু ডোর দিয়ে গাছটির সাথে সাতপাকে বন্ধনে আবদ্ধ ও মোটা ডোর হাতে পরে অপরাধ মার্জনার জন্য নেহর বা দন্ডবৎ জানানো হয়। গাছের প্রাণ আছে, ডাল কাটতে গেলে গাছটি কাঁদবে, এই অনুভূতি ও নেগাচারের কথা প্রচলিত গানে ধরা পড়েছে,-

"করম ডাল কাইটতে গেলি,করম ছলমল

মড়ল বেটা বাহিরাঁঞছে টাঁগি ঝলমল।

সরু ডোরে বাঁধব নেহরিরে

মটা ডোরে বাঁধব পানডরি রে

করম রাজাকে ধুতিঁঞা পরাভরে

ইঁদঅ রানিকে শাঢ়িঅ পিঁধাব।

দে দাদা দে দাদা পিঁঢ়া ছুইলে দে

করম রাজা আসিবেক বসিবেক রে।

দে দাদা দে দাদা মাইছলা বুইনে দে

ইঁদঅ রানি আসি বসিবেক রে।"

ডাল কেটে এনে মড়ল ঘর বা গ্রামের আখড়াই স্থাপন করা হয়। করম ঠাকুর হিসেবেই ডালটি পুজিত হয়।

পাশাপাশি, এই সময়ে বার বা উপোসে থাকা কচি কাঁচারা শাল দাতুনে মুখে নিয়ে নদী বা জলাশয়ে গিয়ে, তেল নেহরি দিবে। এটি দন্ডবৎ হয়ে সূর্য প্রনাম। বলা হয়, "লে রে তেল নেহরি।" সাঁঝে পাড়া ডাক দেওয়া হয়, "আইস রে বার বাতিরা" (বার = উপাস/উপবাস, ব্রতীরা = ব্রত পালনকারীরা),  মতান্তরে পার্বতীরা। করম তলে থালায়, গুঁড়ি মাখিয়ে ঝিঙে পাতায় শুইয়ে কাঁকড় বেটা, অভাবে ঝিঁঙে, কুন্দরি (সৃষ্টির পুরুষ প্রতীক হিসেবে), প্রদীপ জ্বালিয়ে, মা বাবারা কুলো বা মানে নৈবেদ্য (দুধ, কাঁচা হরিতকি, আমলকি ফল ও পাতা, কেঁওয়া যাকে বলে বন শিমুল) নিয়ে তারা হাজির হবে। করমের কোনও মন্ত্র নেই। বদলে ধরমু - করমুর কহনি বা কাহিনী শোনানো হয়। এই কাহিনী থেকেই ধর্মে ও কর্মে মহান হওয়ার শিক্ষা ও শপথ দেওয়া হয়। শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, ন্যায়, অন্যায় সমস্ত বোধই রয়েছে এই কাহিনীতে। ধর্মে ও কর্মে মহান হওয়ার এটিই আদি নীতি কথা। এই করম কাহিনীর অনুসরণেই হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থ ‘গীতা’ রচিত। এখানে প্রবক্তা কৃষ্ণ, শ্রোতা অর্জুন। সেখানে প্রবক্তা সমাজের গুরুজন বা লায়া, শ্রোতা কচিকাঁচা উপাসকরা। বলা বেশি, কুড়মিদের এই সৃষ্টি মহাভারত তো কোন ছার সিন্ধু সভ্যতারও আগের। সিন্ধু নদীর আগেকার নাম ছিল কুড়ম নদী। তার উপত্যকায় কুড়ম সভ্যতায় সিন্ধু সভ্যতার আগের সভ্যতা। ইতিহাস সে রকমই তথ্যের ইঙ্গিত দিয়েছে।

পাহ্নাঃ

পরের সকালে উপাসকরা ফের তেল নেহরি স্নান করতে যাবে। ‘বেটা’কে জলে ভাসিয়ে দিবে। ডাল পুজার উদ্যোক্তারা করম ডাল ও তলের নৈবেদ্য নদী বা খালে ভাসিয়ে দিবে। কচিকাঁচারা স্নান সেরে ফেরার পথে তিন ফ্যাংড়া বিশিষ্ট একটি ধানগাছি তুলে এনে ঘরের দেওয়ালে আল্পনা তলায় রাখবে। সেটিকে গুঁড়ি ও সিঁদুর দিয়ে পুজা করা হয়। তার মুখোমুখি বসে আলতি বা কচু পাতায় বাসি ভাত ও আনলা বা নুন বিহীন ১১ বা ১৩ ধরনের সব্জি মিশ্রিত বাসি তরকারি খেতে হয়। এটিই পাহ্না। পাশাপাশি ঘরের বড় বা ছোট ব্যক্তি সূর্য ওঠার আগে জঙ্গল থেকে পড়াশি, কেঁদ, শাল প্রভৃতি ডাল কেটে প্রতিটা জমিনে, সব্জি মাচার সামনে আঁকদুয়ারের রাস্তায়, গোবর গাঢ়ার সামনে পুঁতে দেয়। এই নিয়ে গানও রয়েছে, 
"ডালি কাইটতে হবেক সকালে
পাহ্না খাতে হবেক ভখালে"

নির্দিষ্ট ভাবে পড়াশি জমিনে, গোবর গাঢ়ায় কেঁদ ও আঁক দুয়ারের রাস্তায় শাল ডাল পোঁতা হয়। পড়াশি পাতা ধানের ধবলি রোগ হাটায়। বিষাক্ত কীটের জ্বালা থেকে অব্যর্থ ভেষজ কেঁদ ডালের ঘষা, গোবরও প্রতিষেধক। 

    সর্বোপরি, এই ডালি গাড়ার মধ্য থেকেই প্রাকৃতিক ভাবে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের জন্ম বা আদি কৌশল। বছর বছর মড়ল বা একই ঘরে করম ডাল পুজা নিয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে যাতে অসন্তোষ দেখা না দেয়, পূর্বপুরুষেরা সেই সমাধানের পথও তৈরি করে রেখেছেন। যদি কারও এই ডালি বেঁচে ওঠে, বা সেদ্ধ ধান যদি কারও বাড়িতে অঙ্কুরিত হয়, তা লায়াকে খবর দিতে হবে। লায়া মিটিং করে বিষটি গ্রামবাসীদের জানাবেন,সেখানেই জানিয়ে দেওয়া হয় পরের বছর ওই ব্যক্তির ঘরে করম ডাল পুজা হবে। পাশাপাশি, পাহ্না খাওয়ার পর কচিকাঁচারা যেখান থেকে ধানগাছি এনেছিল সেখানেই পুনরায় সুন্দর করে রেখে আসবে। এটোঁ আলতি পাতা ও  জলঘটি নিয়ে গুরুজনরা জমি অব্দি যায়। কেননা এই ধান গাছাটি ভাল করে চিনে রাখতে হয়। এটিকে কাটা হয়না। পৌষে সমস্ত ফসল ফরে তোলার শেষে ঠাকুর হিসেবে পুজা কর ফরে নিয়ে আসা হয়। যা হল ঠাকুর আনা। একখন্ড এই অংশের সুত্র ধরে অনেক কলমচি মহল করমকে কানাশোনা কৃষি উৎসব বলেই থুকাম দিয়েছেন! হতে পারে! কেননা শিবকে বৈদিককালে কৃষি দেবতা হিসেবে মেলে। অনেকে বলতে চায় কাঁকড় বেটা শিব লিঙ্গের প্রতীক। আসলে সৃষ্টির পুরুষ সত্ত্বা ও প্রকৃতির মিলই এসবের মূল। তবে মনে রাখতে হবে, বেদ বিধানের বিপরীতেই এই সংস্কৃতি নিজস্বতায় এখনো স্বমহিম। এই করম হল সভ্যতা, সৃ‌ষ্টি, বিজ্ঞান, শরীর, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, কৃষি, ধর্ম, কর্ম, উদ্ভিদবিদ্যা,জীববিদ্যা, আয়ূর্বেদ, সংগীত ও নৃত্য কলা, সবকিছুর শিক্ষার ব্রডব্যান্ড। এই যে পালিত নিয়ম, এতে সামিল থাকে কেবল কুড়মি  - মাহাতরা। একে কেন্দ্র করে যে আনুষ্ঠানিক নাচা গানা হয়, সেই অংশে সহযোগী কামার, কুমার ,মাহলি, মুন্ডা, কড়া, ভুমিজ,সাঁওতাল অনেকেই থাকে। সাঁওতালদের যে "কারাম" তা এই সময় এই নিয়মে পালিত হয় না। কুড়মিদের মূল পরব গুলি অধিকাংশই কৃষি সম্পর্কিত। প্রতিটি পরবের সাথে প্রতিটির যোগ সুত্র রয়েছে। তাই করম শুধু কৃষি উৎসব নয়, তার চেয়েও অনেক বড় কিছু। আগ্রাসনের এই দেশে আদিকালে আদিবাসী জনজীবনের কোনও শিক্ষাঙ্গন ছিল না। কচিকাঁচাদের শিক্ষক ছিলেন সমাজের আদি গুরুজন ও পিতা মাতা। গীত, কহনি, ঝুমুর এসবের মধ্যেই নীতি শিক্ষা দেওয়া হত। সব কিছুকে  একটা জায়গায় এনে শপথ আকারের শিক্ষা দেওয়ার নির্ঘণ্ট হল করম পরব। যারা করম পালন করে থানে শপথ নেয়, সেই সমাজের মানুষ আমৃত্যু অসৎ, বেধর্মী হতে পারেনা। এতটাই কঠোর ও নিয়মের পরব হল করম।

এখন করম নিয়ে এত আনখা, আনকোরা কথা উঠছে কেন! সভ্যতা বিকাশের নামে গ্রামীণ সভ্যতা, সংস্কৃতিকে ছেঁড়া চোঁথা চলছে। এই সমাজেরই একটা অংশ ভিন সংস্কৃতিকে আঁকড়ে এলিয়ট সেজেছে। তছনছকারীরা এই "বিভীষণ" ও বাতানুকুল জানালায় বসে হুলকে কানাশোনা কিছু "গবেষক"দের দিয়ে এই সংস্কৃতির মুন্ডুপাত করতে মরিয়া। ঘরে ঘরে, ভাইয়ে ভাইয়ে, সমাজে সমাজে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে এই বিদ্বেষ ও বিভাজন তাদের শিকারের ফল। করোনা থেকে নিস্তার নেই, কিন্তু এই সমস্যা থেকে নিস্তারের উপায় করম তলে এসে করমুর মত, "প্রায়শ্চিত্ত" করে পুনরায় করম কহনি-তে শপথ নেওয়া। মনে রাখতে হবে যে সংস্কৃতি ভিত সত্য, সুন্দর, শক্ত তা বিনষ্ট করতে দৈব শক্তিও হার মানে।

(লেখক - রিসার্চ ফেলো) 

No comments

Powered by Blogger.