ছেলেবেলা :১ (প্রথম পর্ব) - বন্দিতা রায়
(ঝরঝরে বাংলা গদ্যে অনবদ্য স্মৃতিচারণ...)
নাসরিন মহাশয়াকে সেলাম। আমার ‘ছেলেবেলা’ রূপকথা, ভূত, ব্রহ্মদৈত্য,
শিয়াল, বাঘ এদের গল্পে যে মুগ্ধতা এবং ভয় মিশে আছে, সেই ট্র্যাডিশনটা আমাকে খুব টানে।
আমার শিশুকালটা কেটেছে প্রায় গভীর জঙ্গল এলাকায়,
যখন আমার ‘গেঁড়ি গাই’কে বাঘে নিয়ে যেত। রাত্রি হলেই হুক্কাহুয়া রবে ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে
যেত। তখন তো চোখ বন্ধ করলে বা বিছানায় মুখ গুঁজলে ভয় অনেকখানি চলে যেত। জঙ্গল আমি ভালবাসতাম,
অগভীর জঙ্গলে বেড়ানো এবং খেলার জন্যে অত্যন্ত ভাল জায়গা। দুএকটা বন্য প্রাণী, যেমন
সাপ এবং বেজির দেখা পাওয়া যেত।
শৈশব অতিক্রান্ত করে জঙ্গল ছেড়ে আমি গ্রামে
গেলাম মা, বাবা, দাদু ও ভাই-বোনেদের সঙ্গে থাকতে। সেখানে আমার ‘চাষ ঘর’। আমার মায়ের
পারিবারিক প্রয়োজনে এই পরিবর্তন কেমন লেগেছিল তা খুব ভালো জানি না, তবে তিনি সন্তুষ্ট
হন নি। কিন্তু আমার খুব ভালো লেগেছিল। বড় পুকুর, বাগান পেয়ে বুঝলাম দিনগুলোও ভালো কাটবে।
বাড়িতে খেলার অনেক জায়গা পাওয়া গেল। পুকুরের জলটা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এপার ওপার
সাঁতার কাটার মধ্যে দিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত। বর্ষাকালে কার গালে কতটা গোঁফ
গজিয়েছে প্রতিযোগিতা চলত তাই নিয়ে। বর্ষার জল ঘোলা, তাতে অনেকক্ষণ দাপিয়ে বেড়ালে অনিবার্যভাবেই
সারা গায়ে পলির মত মাটি জমা হত, তাই আমাদের গোঁফ দাড়ি। যার যত বেশি তার তত কৃতিত্ব।
এর পেছনের কারণটা ছিল ‘গদা’ দেওয়ার খেলা। ডাঙ্গায় যেমন – ‘ও কুমীর তর জলকে নেমেছি’,
তেমনই আর কি। যে চোর হবে গুন্তিতে, যেমন – ওবে, দশ, কুড়ি ইত্যাদি গোণা হবে। সবার শেষের
জন চোর। তাকে সাঁতরে জলে আর একজনকে ছুঁতে হবে। ফলে শুধু সাঁতারের ওপর দখল থাকলে চলত
না, যে বেশীক্ষণ ডুব সাঁতার দিতে পারত সেই জিতে যেত। কিন্তু ঐ যে ভাগ্য বলে বলে একটা
ব্যাপার আছে না, তাতে দেখা যেত জলে ডুবে বেচারা কখনো কখনো চোরের কাছেই চলে যেত। এই
খেলাটার খুবই নেশা ছিল। এটা পুরানো হয়ে গেলে পুকুরের পাড় থেকে বেগনা গাছের ডাল ভেঙ্গে
তার তলায় মাটি মাটির তাল লাগিয়ে জলার ফুলে পুজো করে ভাসিয়ে দিতাম। খেয়াল থাকতো না স্কুলে
যেতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি আমরা খিদেও ভুলে যেতাম। কিন্তু ভাই, মাশুল তো দিতেই হতো।
দাদু খড়মের ঠক ঠক শব্দ তুলে ছড়ি হাতে আমাদের জল থেকে তুলতে আসলে আমরা ভয়ে ভয়ে উঠতে
বাধ্য হতাম। এর পরেই ছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপান্বিতা মায়ের শাসন।
আমরা এই খেলাটাকে বড় বড় আম, বকুল গাছেও নিয়ে
গিয়েছিলাম। সেই দিনগুলো বড় সুন্দর ছিল। গাছ থেকে যে পড়িনি তা কিন্তু নয়। কিন্তু তখন
হাত পা ভাঙ্গেনি। একটু আধটু কেটে যেত। আমরা জানতাম কাটার অব্যর্থ ওষুধ তাল তুলো। পুকুর
পাড় মানেই তো তাল গাছের ঘন সারি। যেখানে ছোট তাল গাছে আমাদের হাত যেত, সেই গাছের কচি
পাতার উপর লাল রঙের তুলোর মতো (খুব সামান্য) থাকে – তা সংগ্রহ করে কাটা জায়গায় লাগিয়ে
দিলেই হতো। সেরে না যাওয়া পর্যন্ত ওটা উঠত না।
বাড়ির মধ্যে আর অন্যতম খেলার জায়গা ছিল খামার।
সেখানে খড়ের গাদা, যাকে আমরা বলতাম ‘পালই’ মরাই আছে। আর আড়ালে আবডালে ‘লুকলোকুনি’ খেলা।
আপনারা খেলেন নি? সেই যে ‘কুহু’ বলে সাড়া দিতে হতো। অবশ্যই লুকিয়ে যাওয়ার পরে। তারপর
তো সবারই জানা। এর সঙ্গে আমাদের প্রায় স্বগোত্রীয় জায়গাতেও আমাদের খেলা ছিল। সেটা হল
গোয়াল।
এমনি করে দু’এক মাস কাটার পর দাদু আমাদের প্রাথমিক
স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। আমি দ্বিতীয় ও আমার ভাই প্রথম শ্রেণীতে। তখন আমরা স্কুল বলতাম
না। বলতাম ইসকুল কিংবা বিদ্যালয়।
শুরু হল এক অজানা অধ্যায়। আমাকে দাদু সহজেই
নিয়ে যেতে পারলেন। কিন্তু আমার ভাইকে প্রচুর তাড়না এবং পীড়নের পর সে বিদ্যালয়ে গেল।
একদম ভালো লাগে নি। মেয়েরা যারা এসেছে, তারা সবাই বেশিরভাগই শাড়ি পরা। মোটা রঙিন শাড়ি।
সায়া ব্লাউজের পাট নেই। মাত্র তিন চারজন ফ্রক পরতাম। ছেলেরা প্রায় সমান সংখ্যায় ধুতি
ও প্যান্ট পরিহিত। সার্টের বাহুল্য ছিল না, গেঞ্জি পরাই চল ছিল। (চলবে…)
No comments