Header Ads


 

আজকের কুর্মি সমাজ - সমীর মাহাত

 

আজকের কুর্মি সমাজ

সমীর মাহাত

 

ভাষাবিদদের নাকালের শেষ নেই বিশেষ করে ‘কুর্মি’ নিয়ে। তখনটা আর্য-অনার্যদের হাড্ডাহাড্ডি। একটা প্রবাদ নিয়ে হাড়ে ঝাল দেওয়াই ভালো – ‘যার গইনা তাকেই সাজে/ অইন্য লককে ঠরকা বাজে।’ কেননা লোকজীবন নিয়ে কিছু লেখালেখি করে তবেই আসলি সভ্যতার খুঁট পাওয়া যাবে। নাহলে ঐ ঠরকা বাজতেই থাকবে।

বাঙালীর একচেটিয়া সাহিত্যপনা দাদাগিরিতে যা খুশি হয়েছে বিশেষ করে কুর্মি সমাজের। হাঁটুমোড়া অন্ধকারে পেট পালতে দায় সংস্কৃতিটিকে নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র এক সময়ে নাক গলিয়েছিলেন। ‘বাঙালীর উৎপত্তি’ ‘বিবিধ প্রবন্ধে’ যে আলোচনা করা হয়েছে তাতে অনার্য এই কুর্মি জাতিকে দস্যু বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। খুদ মহাভারতে। আবার সেই বইতেই পাণ্ডুরাজা অনার্য। সেই বইতেই যারাকে জোর করে খোলজবড়া বা দো-হাঁসলা আর্যতে পরিণত করতে চাওয়া হয়েছিল – সাঁওতাল, হো, ভূমিজ, মুণ্ডা, বীরহোড়, কড়ুয়া, কুর বা কুর্ক এবং জুয়াং এরা। এই কুর বা কুর্ক থেকে কুর্মি জাতি লোটাকম্বলে টিকে আছে একথা সত্য। আর্যদের কাছে হেরে যাওয়ার পর বাঁচতে দায় হল এদের। আশ্রয় নিল পাহাড়ে জঙ্গলে। না হল তাদের সাহিত্য, না হল সৃজন চর্চা। বাঁচা বাদে পৃথিবীতে আর কিছু তাদের কপাল ভাঁজে নেই। কেউ বলে থাকে ‘কুড়েমি’ পাহাড়ে তাদের জীবনের মেন আখড়া ছিল। মোটকথা আগের ব্যুৎপত্তিটাই ধ্রুব। সারা পৃথিবীর সাথে সেই বদলার ফোঁসটা মেদিনীপুর বাঁকুড়া পুরুলিয়াতেও ফোঁসাচ্ছে। তার পাশে আর্যদের চাবুকও চলছে। অনুপাতে অনুপাতে পৃথিবী বেশ নাকাঝালা হচ্ছে। আর্য : অনার্য। রাবন : রাম। ধনতন্ত্র : গণতন্ত্র। পুঁজিবাদ : পাচাটাবাদ। চলতি মরশুমে ‘সন্ত্রাস’ নামক শব্দটা তালে কি অনার্যদের ক্ষোভ! রামের উপর বদলা? তালে বোকাচন্দর হনুমানরা গেল কোথায়?

ভদ্রলোক সুনীতিকুমার যখন ঝাড়খণ্ডী উপভাষার নাম দিলেন তখন কুর্মি হাওয়ারাচাটা গেল কোথায়? আর্য যুগ থেকে চৈতন্য যুগ কখনই বেশি মান্ধাতা নয়। যাদের ভাষা আছে, জ্বালা আছে, জীবন আছে অথচ এই মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়াতে এরা ব্যবহৃত হয় পত্রিকার কভার পেজে কিম্বা স্তন খোলা পালস পোলিওর বিজ্ঞাপনে। বাদে কোথাও ফ্যান নেই। এরাই পৃথিবীর সব দিয়েছে বলে পৃথিবীর খেয়াতরী আজ এদের বইতে পারে না। রাবণের বংশধর, বল আছে বুদ্ধি নেই। এরা নেতাদের প্যাঁদানি খাওয়া জনগণ। এদের জীবনের ওয়ারিশ নেই। কনট্রাকটারের ঠিকাদার ছাতি ঝাঁঝরা করা। জাতটা নারায়ণ গঙ্গোর ‘টোপ’, বুঢ়া আঙ্গুল চুষতে জানে বাঁদরের কলা ছাড়াতে জানে না। সমাজটা স্বপন মহান্তীর ‘লছমনের বিটি’ দুঃখের জ্বালায় মদ খেয়ে কামিন পাড়ায় ধর্ষিতা হয়ে কবরে যায়।

এই কুর্মিরা চির সংগ্রামী ম্যাক্সিম গোর্কি-র ‘মা’। এরা যে হোক করে খতম হওয়া চুনি কোটাল। এরা ‘পহিল দবন তাঁহে কানা বীর বুরু গাজাড়রে এনহঁ কুর্মি জাতি চেদা নিধান রে’। এরা পথে পথে জিন্দাবাদ তোলা কুকুর, ঘেউ করে, রুটি পায় না। ঘা দিয়ে লুটও করতে জানে না। এরা পেটের দায়ে বেশ্যাখানায় যায় না। হাঁড়িয়া বিক্রি করে খুঁটে খুচরো বাঁধে আধপোড়া খুদি চালের যোগাড়ে।

(লেখক ‘এডিটর’ পত্রিকার সাংবাদিক এবং ‘ঊষর মাটি’ পত্রিকার সহ সম্পাদক)

No comments

Powered by Blogger.