Header Ads


 

আলোড়ন - সোমনাথ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়



আলোড়ন - সোমনাথ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়


       গহীন ‘অরণ্যলোক’ সেখানে আলো ঢোকাই ভার। গাছেরা মাথা তুলে, সূর্যের দিকে দু’হাত বিছিয়ে উদাত্ত, মাটি সেখানে নারীর মতো অসূর্যম্পশ্যা। পুরুষ বৃথা সেখানে আকাশমুখি, নারী মৃত্তিকা সেখানে অন্তঃসলিলা। ‘সলিলা’ শব্দে আপত্তি নিশ্চয়ই থাকবে না কারোর। এই মৃত্তিকায় এই অরণ্য ছায়ায় এক মায়া সভ্যতা। সেই সভ্যতায় মানুষ বড় সরল। এতটাই সরল যে অনেক সময় বুদ্ধিহীন আবেগকেই এখানে সরলতার ব্যাখ্যায় ফেলা হয়। এই অরণ্যলোকে কেউ কেউ সরকারী হলফনামায় যৌবনেই চলে আসেন বানপ্রস্থে। তার পর দৈর্ঘ্যে প্রস্থে যথেষ্ট বৃহৎ হয়ে ওঠেন, কেঁদো বাঘের মতো। অরণ্যের মৃত্তিকা অপর্ণা হয়ে পড়ে থাকে। তার সারা শরীরে পর্ণপত্রের স্খলিত আচ্ছাদন। বাইরের ঐ সরকারী কেঁদো বাঘেরা মানুষখেকো। হালুম করে না ওরা। খুব ধীরে ধীরে খায়। কলকাতার আমি-তুমি সংসারে যেমন ফ্রিজে রান্না করা মাংস সারা সপ্তাহ ধরে চলে। রবিবার শুধু বাজার দিন।

       অরণ্য কি শ্বাপদ তৈরি করে? শ্বাপদের একটা বড় সুবিধা আছে। মৃত্তিকা থেকে সেই ‘পদ’ শরীরকে অনেকটা নিরাপদ দূরত্বে রাখে। কিন্তু হিসহিসে হয়ে ওঠে দাঁত আর চোখ। শ্বাপদ অরণ্যে বাস করেও উদ্ভিদভোজী নয় নিরামিষাশী নয়। নৈমিষারণ্যে তাদের অরণ্যে বসবাস। শুধু অক্সিজেন আর অক্সিজেন। দাহ্য করে তোলে ঐ শ্বাপদদের। কারণে অকারণে ওদের চোখে জ্বলে ওঠে জিঘাংসা। পিছনের দুটো পা ওরা অনুক্ষণ ঘষতে থাকে। শিকারের অপেক্ষায় ওরা বড় একা। অরণ্য কি দু’রকম মানুষ বানায়? ঋষি আর শ্বাপদ? শ্বাপদও কি এক সময় ঋষি হয়ে ওঠে না? সিংহের মাথায় কেশরও কি ঋষির জটা? সভ্যতা থেকে অরণ্য অনেক দূরে, কবিগুরুর সংজ্ঞা থেকেই ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।’ অরণ্যকে নগর সভ্যতা অন্তর থেকেই কি পর্যুদস্ত করে? তাই কি অমন কথা বলা হয় ‘কংক্রিটের জঙ্গল’! আমাকে ছাত্র লিখেছিল ‘সত্যচরণ’ আপনি। বিভূতিভূষণ নগর থেকে যাকে অরণ্যে পাঠালেন তিনি হলেন ‘সত্যচরণ’ – সত্যদ্রষ্টা হবেন যিনি, তাঁর নামকরণ যখন লেখক করেন, তখন তার মধ্যে কি কোনো ইন্ধন থাকে না? অরণ্যের অন্ধকারে যিনি এসে অদ্ভুত দৃষ্টিলাভ করবেন, তিনি হবেন সত্যচরণ। নগর সভ্যতার ছানি কেটে সত্যচরণ পেলেন সত্যদৃষ্টি, এ সত্যদৃষ্টি সত্যচরণ লাভ করলেন। অরণ্যের ধ্যান-মগ্নতায়। আবিষ্কার হল এমন কিছু মানুষ, যারা যৎকিঞ্চিত ভাবে অরণ্যে জীবন কাটান, অন্য এক ধ্যানে। নগরের মানুষের আগ্রাসী লোভী এবং ক্রমবর্ধমান বাসনার হুতাশে এই সমস্ত মানুষেরা যেন অদ্ভুত এক শিক্ষা। যে শিক্ষা মানুষগুলি তাদের সশরীর বিদ্যমানতা দিয়ে প্রমাণ করে। এই সমস্ত মানুষগুলির মহত্ত্ব, তা স্বাভাবিক চোখে ধরা পড়ে না। এক দল মানুষ অরণ্যচারী, ‘হেমন্তের অবিরল পাতার মতোন’ যারা মিশে যেতে চায় নিস্তব্ধ-নিঃসঙ্গ জীবনের এক কৃচ্ছ্র নিরবিচ্ছিন্নতায়। আর একদল দুরন্ত বালকের মতো। অরণ্যের নিস্তব্ধতা কোলাহলে ভাসাই যাদের বালখিল্য বৈশিষ্ট্য।

       অরণ্যলোকের পাতায় পাতায় বিজ্ঞাপিত হয় ‘আলোড়ন’ সৃষ্টিকারী অধ্যাপকের কথা। চিন্তায় যিনি আকাশের দিকে ঊর্ধ্বমুখ, অন্তরে যিনি মাটির মতো অহল্যা পাষাণীপাষাণ থেকে ‘মানবী’ হয়ে ওঠার অরণ্য সাধনায়, তিনি হয়তো অপর্ণা, ঋষির ধ্যানে তিনি মহামায়া, সিংহবাহিনী। চারিদিকে ঢাক বাজে, বিজ্ঞাপ্নে সানন্দিত ঢাক, অরণ্যে ঢাকের শব্দ তো এমন কথাই ঘোষণা করে ‘পালাও পালাও’। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর মেহের আলি সারা রাত্রি চিৎকার করে ‘তফাৎ যাও তফাৎ যাও’। কোথায় যাব, পালাব কোথায়, ছুটব বা আর কত? অরণ্য লিঙ্গ পরিবর্তন করে? ‘অরণ্য’ পুরুষ শব্দ। কিন্তু এমন পুরুষ সে, যে তার সন্তানদের খাদ্য যোগায়, আশ্রয় যোগায়, অরণ্য তখন মাতা। দেবী অরণ্যের পূজা হয়, অরণ্যব্রত। গহন অরণ্য গহনা পরে পুষ্পমালার পৌরুষের মধ্যে নারীত্বের এই আলোড়ন উদ্ভাস। চমকে দেয় সবাইকে। মুগ্ধ সবাই। 

 

No comments

Powered by Blogger.