গ্রন্থ পর্যালোচনা - ড. পরিতোষ মাহাত
গ্রন্থ পর্যালোচনা
গ্রন্থ – ‘আঞ্চলিক ভাষার আবৃত্তির কবিতা’
আলোচক – ড. পরিতোষ মাহাত
বাংলার আঞ্চলিক ভাষার কবিতার নানা গ্রন্থ ও সঙ্কলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। এই ধারায় এক নবতর সংযোজন উত্থানপদ বিজলী সম্পাদিত ‘আঞ্চলিক ভাষার আবৃত্তির কবিতা’। এটি একটি আঞ্চলিক কবিতার সঙ্কলন গ্রন্থ।এই সঙ্কলনে স্থান পেয়েছে দেড়শো (১৫০) কবির দুশো এগারোটি (২১১) আঞ্চলিক কবিতা। এখানে কবিদের মধ্যে খ্যাতিমান কবিদের কবিতা যেমন আছে, তেমনই আছে মৌলিক ধারার আঞ্চলিক কবিদের কবিতা। পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া সহ বাংলার প্রায় সমস্ত জেলার আঞ্চলিক ভাষায় রচিত কবিতা এই সঙ্কলনকে সমৃদ্ধ করেছে। অন্যান্য সঙ্কলন গ্রন্থের তুলনায় এই গ্রন্থের অভিনবত্ব হল এখানে দক্ষিণ ২৪ পরগণা তথা সুন্দরবন অঞ্চলের কথ্য ভাষায় রচিত বেশ কিছু কবিতা সঙ্কলিত হয়েছে। মূলত আবৃত্তিকারদের কথা মাথায় রেখেই এই সঙ্কলন।
আবৃত্তি আজ একটি সম্মানজনক ও জনপ্রিয়
শিল্প হয়ে উঠেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে আবৃত্তিকে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আঞ্চলিক ভাষার কবিতা সঙ্কলনে প্রধানত দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার আঞ্চলিক ভাষা,
কদাচিৎ প্রান্ত-উত্তরবঙ্গের ভাষাকে ভিত্তি করে রচিত কবিতা স্থান পেয়ে থাকে। এই গ্রন্থে
সুন্দরবন তথা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার আঞ্চলিক কথ্য ভাষার স্বরূপ কবিতার মাধ্যমে
আমাদের কাছে উপস্থাপিত করেছেন। সুন্দরবন অঞ্চলের ভাষায় কবি ও সম্পাদক উত্থানপদ
বিজলীর কবিতা ছাড়াও রয়েছে কবি কালিপদ মণি, কৃষ্ণকালী মণ্ডল, ক্ষুদিরাম পুরকাইত,
তুহিনময় ছাটুই, ধূর্জটি নস্কর, নরোত্তম হালদার, পঞ্চানন দাস, পুণ্ডরীক চক্রবর্তী,
প্রদীপ কুমার বর্মণ, বলাই হালদার, বংশীধর নাইয়া, বিমলেন্দু হালদার, মনোরঞ্জন
পুরকাইত প্রমুখের বেশ কিছু আঞ্চলিক কবিতা। কথ্যভাষার যথাযথ রূপ লিপিবদ্ধ করা
পরিশ্রমের। এক্ষেত্রে কবিরা যথেষ্ট যত্নবান। যেমন –
“তোঙগার
মোতোন ভদ্দরনোকের কোতায়
এত্তোন
এইচি এই বকখালিতি।
একোন
ঝুজকো, কওশায় ডুবে গেচে দুরির বাদাবন
ঝাউবনের
উদিকির আস্তায় একোন জনমানিষ্যি নি’
বাবু,
উদিকি যাবুনি।” (‘বাবু, আমি উদিকি যাবুনি’, উত্থানপদ বিজলী)
ভাষাগত বৈচিত্র্যে বাংলার উপভাষার জগৎ যে
কত ব্যাপক ও বিস্তৃত, তার স্মারক গ্রন্থ হয়ে উঠতে পারে এই কাব্য সঙ্কলন। সম্পাদকের
সযত্ন রুচিশীলতার ছাপ গ্রন্থে রয়েছে। আঞ্চলিক কবিতা সঙ্কলন সম্পর্কে যে কথাটা মনে
রাখা দরকার, তা হল এই জাতীয় কবিতা রচনা যাঁরা করেন, তাঁরা মূলত স্থানিকভাবেই
পরিচিতি পেয়ে থাকেন। সারা বাংলায় কোন কোন লিটল ম্যাগাজিনে তাঁদের কারো কারো লেখার
সন্ধান পাওয়া যায়। তাই তাঁদের অনেকেই স্বল্প পরিচিতির ব্যবধান অতিক্রম করতে পারেন
না। সুতরাং, সম্পাদকের একটা দায়িত্ব এসেই যায় সংক্ষিপ্তভাবে হলেও কবি-পরিচিতি
প্রদানের। সেটা না থাকলে সাধারণ পাঠকদের ওপর বাড়তি শ্রমের বোঝা চাপে। পাঠক এমনিতেই
সমস্ত উপভাষা জানেন না। কবির সম্পর্কে কিছু বলা থাকলে সেই কবির কবিতার ভাষা কোন
অঞ্চলের তা অনুধাবন করতে সুবিধা হয়। ‘কবিতার ভাষা’ বাংলা আধুনিক কবিতার জগতকে যেমন
দুরধিগম্য করেছে, তেমনই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের কারণে আঞ্চলিক কবিতা জনসাধারণ্যে
দুরধিগম্য। যদিও কবিতার বই মানে অভিধান গ্রন্থ নয়, কিংবা শব্দের অর্থ দিয়ে কবিতা
বোঝার চেষ্টা করা উচিত নয়; তবু অপরিচিত শব্দের অর্থ তালিকা থাকলে আঞ্চলিক কবিতা
বুঝতে পাঠকের সুবিধা হয়। পরবর্তী সংস্করণে সম্পাদক এদিকে দৃষ্টি দিলে ভালো হয়।
বইয়ের ছাপার মান ভালো। বাঁধাই যথাযথ। কিন্তু কাগজের মান আর একটু ভালো হওয়া দরকার
ছিল। গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী প্রণব হাজরা। প্রচ্ছদ যথেষ্ট হৃদয়গ্রাহী ও
দৃষ্টিনন্দন। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ভৈরব গ্রন্থালয়, কলকাতা
– ৬ থেকে। প্রকাশকাল জানুয়ারি, ২০১৭। মূল্য – ১৫০ টাকা মাত্র। (ISBN:
978-93-81673-62-1).
No comments