Header Ads


 

কবি উপন্যাসে প্রতীকের ব্যবহার - তন্ময় বিশ্বাস

 

কবি উপন্যাসে প্রতীকের ব্যবহার

তন্ময় বিশ্বাস

বীরভূমের লালমাটির সোঁদা গন্ধ আর আউল বাউল কবির গানের সুর যে উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে তার নাম তারাশঙ্করের ‘কবি’। ‘কবি’ নিতাইয়ের কবিয়াল হয়ে ওঠার গল্প। ‘কবি’ রাঢ়ী গ্রামবাংলার জীবন কাহিনী।

উপন্যাস ‘কবি’, পড়তে পড়তে মন কেমন করে ওঠে। উদাস মাঠে যেন গান ভেসে চলেছে। ছুটে চলেছে যেন সুর। লাল ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে গানের পঙক্তি। হু হু উত্তুরে বাতাসে যেন কে একটানা গান গেয়েই চলেছে। কৃষ্ণচূড়া গাছ, স্টেশন, মাঠ, কাশ ফুল, নদীর জল। ট্রেনের কামরা, আসরের শতরঞ্জি সবাই যেন গান করছে। কেউ যেন বলছে আলোর গল্প, কেউ যেন কইছে ছায়ার গল্প।

‘কবি’র প্রতীকী ব্যাপারটা দেখা যাক। ‘প্রতীক’ কথাটার মানেই হল আলো ছায়া। একে বুঝতে হয় অনুভব দিয়ে-হৃদয় দিয়ে। না বলা কথা বা আধেক বলা কথার কথ্যরূপ প্রকাশ করতেই প্রতীকের পরিস্ফুরণ।

এবার মূল কাহিনীর ভিতরে প্রবেশ করা যাক। গল্পটা এই রকম। নিতাই, ডোম বংশীয়। কিন্তু তার হৃদয় সহজাত লবনাক্ত রসে সিক্ত নয়। সে কবি, স্বভাব কবি। ঠাকুর-ঝি প্রেরণাদাত্রী। রাজন। অনুরক্ত ভক্ত। ঘটনাক্রমে দেহ ব্যবসায়িনী ঝুমুর সঙ্গীত পরিবেশক বসন্ত বা বসনের প্রবেশ। নিতাই এর সরল রৈখিক জীবন ধারা থেকে চ্যুতি, জীবনে মোড়। শেষে,আবার স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তন। এই হল উপন্যাসের সাংকেতিক রূপ।

আলোচনার সুবিধের জন্য কাহিনী ধারাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন প্রথম পর্বে নিতাই কবিয়ালিতে পাল্লা দিয়ে গ্রামে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এইখানে ঠাকুর ঝির সঙ্গে সম্পর্কে অঙ্কুরায়িত হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে ঠাকুরঝি’র সঙ্গে সম্পর্ক মানসিক দৃঢ়তা ও হতাশা বোধ সৃষ্টি করেছে। এই পর্বেই ঝুমুর দলের আগমন নিতাইয়ের জীবনে এক নতুন মোড় সৃষ্টি করেছে। তৃতীয় পর্বে রয়েছে নিতাইয়ের ঝুমুর দলে আগমন ও কবিয়ালির পুনঃস্বীকৃতি। চতুর্থ পর্বে রয়েছে এক ট্র্যাজিক মোড় বসনের মৃত্যু ও জীবনধারায় অঙ্কুশ নিতাইয়ের। এর পরিণতিতে পঞ্চম পর্বের গোড়ায় রয়েছে কাশী যাত্রা। শেষের দিকে প্রত্যাবর্তন। এবার প্রতীকী ভাবনা কোথায় কেমনভাবে বিন্যস্ত আছে দেখা যাক।

উপন্যাসের দুই নায়িকা। বসন্ত, ঠাকুরঝি। প্রথম পর্বের নায়িকা ঠাকুরঝি – শান্ত, মার্জিত, নম্র স্বভাবের। কালো তার গায়ের রঙ। সে পাশের গ্রাম থেকে দুধ বেচতে আসে। সে আবার নিতাইয়ের পরম বন্ধু রাজনের শ্যালিকা। নিতাই দুধ নেয় তার কাছে। কবিয়াল নিতাই ঠাকুরঝির কোমল কচি পাতার মত সরস ভুঁইচাঁপার মত সরল মুখখানি দেখে গান বাঁধে। অন্য নায়িকা বসন, উন্মত্ত নিম্ন শ্রেণীর দেহপোজীবিনী – ঝুমুর দলের লাস্যময়ী মদ্যপায়ী নারী। সে নিতাইয়ের জীবনে এসেছে ভিন্নতর মাত্রা নিয়ে। দেখা যাচ্ছে – দুই নায়িকা সংযোগে নিতাই পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আবার ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে দুই নায়িকা স্বভাব চরিত্র গঠনে দুই প্রকার ভাবে সাহায্য করেছে। ঠাকুরঝি নিতাইকে যোগান দেয় দুধ অর্থাৎ পুষ্টি রস। যে রসে নিতাই অবগাহন করে নিজের মানসিক বিকাশ ঘটিয়েছে। বসন যোগান দেয় মদ অর্থাৎ উন্মাদনার উপকরণ। এই উন্মাদনায় নিতাই নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে। সমালোচক অচিন্ত্য বিশ্বাসের মতে, রেল লাইনের একটি পাত যদি বসন্ত ও অপরটি ঠাকুরঝি হলে, বাঁকের মুখে যেখানে পাত মিশে গেছে মনে হয় সেখানেই যে দ্বৈত সত্তা এক ও অভেদভাবে বিরাজমান। এই পথেই ‘ঠাকুরঝি, বসন – দুজনে যেন পাশাপাশি দাঁড়াইয়া আছে।’ (২১ পরিচ্ছেদ)

তারাশঙ্করের উপন্যাসে কৃষ্ণচূড়া গাছ ফিরে ফিরে এসেছে। বিশেষ করে ‘কবি’ উপন্যাসে। ঠাকুরঝিকে প্রত্যক্ষ করার উদ্দেশ্যে নিতাই রোজ কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় বসে অপেক্ষা করে। কৃষ্ণচূড়া ফুল উপহার দেয় প্রেরনাদাত্রী ঠাকুরঝিকে। লাল কুঁড়ি দেখে দেখে গান জাগে – ‘কালো চুলে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?’

আর উপন্যাসের শেষ লগ্নে কাশী থেকে ফেরার পর সে দেখতে পায় ‘ঘন সবুজ চিরল চিরল পাতায় ভরিয়া উঠিয়াছে; তবু দুই চারিটি ফুল’ যেন তার জন্য প্রতীক্ষায় আছে।’ এ যেন অনন্ত প্রতীক্ষা। মুরলীধারীর রাধা প্রতীক্ষা। এর স্বাদ মেটে না। নিতাইয়ের বার বার মনে হয় যেন ঠাকুরঝি বসন দুজনেই তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ঐ কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়। একে কি আমরা অতৃপ্ত অভিসারের প্রতীক হিসেবে কল্পনা করতে পারি না?

উপন্যাসে দেখা যায় নায়ক নিতাই তিন বার হোঁচট খেয়েছে। আর প্রতি ক্ষেত্রেই তার জীবনে নতুন মোড় এসেছে। সাত পরিচ্ছেদে প্রথমেই দেখতে পাওয়া যায় চণ্ডীতলায় যাবার সময় নিতাই হোঁচট খেয়েছে। ‘বিষম হোঁচট’ যাতে তার পায়ের নখ ফেটে ‘রক্ত বাহির হইয়া পড়িল’। তারাশঙ্করের মতে, ‘কালো চুলে রাঙা কুসুমের শোভা দেখিয়া গান রচনা করা কবি হওয়া চলে, কিন্তু ও শোভা দেখিতে দেখিতে পথ চলা চলে না।’ বাস্তব বড় রূঢ়। বাস্তব মালভূমিতে কিছুতেই গোলাপ চাষ করা যায় না। এই হোঁচট যেন বাস্তব আর কল্পনার মধ্য বিরাজমান। আবার আলেপুরের মেলায় ঝুমুর দলে যোগদান করতে যাওয়ার সময় ‘পথিমধ্যে হঠাৎ একটা লোকের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খাইয়া নিতাইকে দাঁড়াইতে হইল।’ (১৩ পরিচ্ছেদ) কাশীতে সে ষ্টেশনের থেকে নেমে ‘সে যেন হোঁচট খাইয়া দাঁড়াইয়া গেল। সে বিব্রত এবং বিহ্বল হইয়া অনুভব করিল, সে কোন বিদেশে আসিয়া পড়িয়াছে।’ (২১ পরিচ্ছেদ) এই দুই ক্ষেত্রেই নিতাইচরণ বাস্তবের মুখোমুখি। এই হোঁচট যেন বাস্তবের প্রতিরূপ।

উপন্যাসে সব থেকে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে ‘চার রাত্রি’। প্রথম রাত্রিতে নিতাই চণ্ডীমণ্ডপে কবি হিসেবে গণসমর্থন পেয়েছে। তার ফলস্বরূপ পরবর্তী অধ্যায়ে নিতাই নিজেকে বিস্তৃত করেছে। দ্বিতীয় রাত্রি নিতাইয়ের জীবনে এসেছে চৈতালি ঘূর্ণি হয়ে। ঝুমুর দলের বসন নিতায়ের কক্ষে রাত্রিবাস করেছে ভেবে নিতাইয়ের মনের মানুষ ঠাকুরঝি উন্মাদ হয়েছে। তৃতীয় রাত্রি নিতাই কাটিয়েছে গঙ্গার শ্মশানে। দেখেছে নক্ষত্রের মিছিল। শিয়াল কুকুর প্রভৃতি শ্মশানচারীদের কলহ দেখেছে। সে কাশীতেই থেকে যাবে বলে ভেবেছে। চতুর্থ রাত্রে নিতাই উপলব্ধি করেছে জীবনের সত্যতা। সে বুঝতে পেরেছে মানব জীবনে দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখকে নিরসন করা যায়। দেখা যাচ্ছে প্রতিটি রাত্রিতেই তার জীবনে নয়া মোড় এসেছে। ‘কবি’ উপন্যাসে আরো অনেক গভীর ব্যঞ্জনাময় প্রতীক লুকিয়ে আছে। যেমন ছোট লাইনের ট্রেন, বড় লাইনের ট্রেন, আকাশের নক্ষত্র, কালপুরুষ, ইত্যাদি। এই স্বল্প পরিসরে তা আলোচনা করা দুষ্কর।

তথ্যসুত্র ও ঋণ স্বীকার-

 ১) অচিন্ত্য বিশ্বাস - তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি

২) দেবেশ কুমার আচার্য – কবি : তারাশঙ্করের জীবন-অন্বেষা   


No comments

Powered by Blogger.