Header Ads


 

টুসু গানে পারিবারিক ছবি - ড. বিজন কুমার মণ্ডল

 


টুসু গানে পারিবারিক ছবি
ড. বিজন কুমার মণ্ডল


‘বাপের ঘরে ছিলম ভাল কাঁখে গাগরা চাল ভাজা।

শ্বশুর ঘরের বড় জ্বালা লক বুঝাতেই যায় বেলা।।’

বাংলার পারিবারিক জীবনে এই ছবি চিরন্তন। সমাজ বিবর্তনের ধারায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের যন্ত্রণার দিকগুলি লোকসাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় প্রতিফলিত হয়েছে। যে কোন আঞ্চলিক নিরিখেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। বিবাহিত জীবনের প্রাথমিক জীবনে শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে মেয়েদের ভয়ের অন্যতম কারণ হল অত্যাচার। শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-দেওর এমনকি স্বামীও বাড়ির বৌকে নিপীড়ন করে। বাড়ির নতুন বউটি সবসময় ত্রস্ত হরিণীর মত বিচরণ করে। সামান্য ত্রুটি যাতে না হয়। সামান্য ত্রুটি কখনও কখনও অসামান্য ঘটনায় পরিণত হয়। তাই তো বাপের বাড়ির সুখ স্মৃতিতে মাঝে মাঝে সে আপ্লুত হয়ে ওঠে। অবশ্য লোকসাহিত্যে শাশুড়ি ও ননদের অত্যাচারের কাহিনী বেশি করে ধরা পড়ে। উপরিউক্ত গানের মধ্যে বাপের বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ির তুলনামূলক বক্তব্য ধরা পড়েছে। এই গানটি হল টুসু গান।

টুসু গান গাওয়া হয় টুসু উৎসবকে কেন্দ্র করেই। টুসু উৎসব হল ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের লোকউৎসব। উৎসবের সূচনা হয় অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে। সারা পৌষ মাস ধরে চলে টুসু গানের চর্চা। পৌষ সংক্রান্তিতে ঘটে উৎসবের সমাপ্তি। বাড়ির মেয়েরাই এই উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। অনেকের মতে এই উৎসব হল শস্যোৎসব। আবার অনেকে একে ফসল তোলার উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যাইহোক, টুসু উৎসবের সঙ্গে টুসু গানের অবিচ্ছেদ্য যোগ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় টুসু গানের চর্চা করেন উৎসব পালনকারী মেয়েরা। আসলে গানই হল টুসুর উপজীব্য মাধ্যম। তাই তো টুসু গানে পাওয়া যায় আঞ্চলিক জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি। বাস্তব জীবনের নানা ঘটনা, কামনা বাসনা, আবেগ-উচ্ছ্বাস, পারস্পরিক সম্পর্কের সামগ্রিক চিত্র অনাবৃতভাবে এই গানে সহজভাবেই প্রকাশ পায়। তাই আঞ্চলিক লোকসঙ্গীত হিসেবে টুসুর গুরুত্ব অপরিসীম।

মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হল লোকসঙ্গীত। স্রষ্টার অনুভূতির প্রকাশ ঘটে এই গানের মধ্যে। গ্রামীণ মানুষের হৃদয়েই এর উৎস স্থল। মানুষের ভয়, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার শক্তির প্রবাহ হিসেবে কাজ করে বন্যার স্রোতের মত অবিরাম দ্রুত গতিতে ভাবনাগুলো এগিয়ে চলে – তারই মধ্যে থেকে ছোট ছোট ভাসমান ফুলের মত খণ্ড খণ্ড ভাবনার প্রকাশ ঘটে এই সব গানের মাধ্যমে। গান হল মুখ্যত কথা ও সুরের সমষ্টি। গানের ভাষা ও সুর গানকে আঞ্চলিকতার বাতাবরণে আবদ্ধ রাখতে পারে। যে কোন আঞ্চলিক গানের মধ্যে প্রকাশ ঘটে যে কোন একটি ভাব বা বিষয়। একাধিক বিষয়ের সমষ্টির নিরিখেই আঞ্চলিক গানের সাহায্যে সেই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা যেতে পারে। সার্বিক বিচারে সব ধরনের লোকগানের কথা ও সুর বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। -

(ক) লোকগানের মধ্যে সহজ কথা ও সরল সুরের প্রয়োগ ঘটে।

(খ) সুরের মধ্যে ছন্দ ও অলংকারের বৈচিত্র্য নেই।

(গ) নৈসর্গিক নির্ভরতা লক্ষ্য করা যায়।

(ঘ) আঞ্চলিক ভাষা ও সুরের দাগ সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।

(ঙ) প্রকৃতিগত উপমা ও ব্যবহারিক উপাদানের উল্লেখ থাকে।

(চ) গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

(ছ) ঐতিহ্যগত ধারার অভিজ্ঞতা পরিলক্ষিত হয়।

(জ) সাময়িক জীবনের ছায়া প্রতিবিম্বিত হয়ে থাকে।

গানের স্রষ্টা মুখে মুখেই গান রচনা করায় তার সামনে দৃশ্যমান পারিপার্শ্বিক জগতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আঞ্চলিক পরিসরেই এক একটি লোকসঙ্গীতের বিকাশ ঘটে। অবশ্য প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলের সবটাই গানের বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয় না। যে সকল বিষয় স্রষ্টার চিত্তে সাড়া জাগায় অর্থাৎ লোকমনের আবেদন যে সব বিষয়ের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয় – তাই শুধুমাত্র লোকগানে সঙ্গীত হয়ে থাকে। এর ফলে এই গান ব্যক্তির সৃষ্টি না হয়ে সমষ্টির সৃষ্টি হিসেবে পরিগণিত হয়। টুসু গানের মধ্যেও নারী হৃদয়ের ব্যথা, দুঃখ, বেদনা, আনন্দ – যা সহজেই তার চিত্তকে নাড়া দেয়, তাই প্রতিফলিত হয়। টুসু গান যেহেতু মেয়েদের গান তাই স্বাভাবিকভাবে তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সমস্যা প্রতিফলিত হয়।

টুসু গানে পারিবারিক জীবনের সুখ দুঃখ, ব্যথা বেদনা প্রভৃতি অনুভূতি সহজভাবে সজীব হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মেয়েদের জীবনের নানা ঘটনা এই গানে লক্ষ্য করা যায়। বিয়ের আগে বাপের বাড়ি ও বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়ির বিভিন্ন দিকগুলো নারীহৃদয়ে বার বার অনুরণিত হয় – যা এই গানে ফুটে ওঠে। বাপের বাড়ির সকলের ভালোবাসার দিকগুলি প্রকাশ পায় মেয়ের বিয়ের পর। বাবা, মা, ভাই, বোন – সকলে তাদের প্রিয় বাড়ির একজনকে অন্য বাড়িতে পাঠাতে যে কী যন্ত্রণা, তা টুসু গানে ফুটে ওঠে –

‘বাপে বলে ছাড়ব ছাড়ব মায়ে বলে ছাড়ব না।

ভাইয়ে বলে ঝিউড়ি ছেল্যা কাঁদায়ে পাঠাব না।।’

মেয়ের বিদায়ের এই দৃশ্য শুধু ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের নয় সমগ্র বাংলায় এই দৃশ্য দেখা যায়। এই সার্বজনীন সত্য এখানে ধরা পড়েছে।

       এই মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার পর তার যন্ত্রণার ব্যাপ্তি ঘটে। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, এমনকি স্বামীটিও তার ওপর অত্যাচার করে। টুসু গানে শ্বশুর বাড়ির লোকজনের অত্যাচারের নানা ঘটনা বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। ‘শ্বশুর ঘরে বড় জ্বালা লক বুঝাতেই যায় বেলা।’ – নির্যাতিতা বধূ বাপের বাড়ি এলে আর শ্বশুর বাড়ি যেতে চায় না। টুসু গানে এই ছবি সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে –

‘মায়ে বলে হেঁ গ বিটি এত কেনে শুখালি।

শ্বশুর ঘরের ফপরা মুঢ়ি সেই খাঁইয়ে শুখালি।।’

অত্যাচারিতা শাশুড়ির অত্যাচারের জন্যেই শ্বশুর বাড়ি যেতে চায় না। মায়ের কাছে অকপটে তা স্বীকার করে। অসহায় গৃহবধূ মেয়েকে রক্ষা করার কোন ক্ষমতা থাকে না। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অত্যাচারিতার কাছেই মেয়েকে পাঠাতে বাধ্য হয়। অবশ্য শাশুড়ি মারা গেলেই সে হয়ে যায় কর্ত্রী। তখন সব কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যায়।

শাশুড়ি যত দিন বেঁচে থাকে, ততদিন শাশুড়ির সঙ্গে ননদও তাকে পীড়ন করে। সেই ননদের অকাল মৃত্যু তার কাছে আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। টুসু গানে শোনা যায় –

‘ভাত রাঁধেছি ডাল রাঁধাছি গেলাসে দুধ ঢাল্যেছি।

খাবার বেলি খবর আইল্য তার ননদ মরে গেল।।

ননদ মরল ভাল হইল পেটের ভাত জিরুন গেল।

ছট বেলায় সাঁতাই ছিল তাই হঁতে যমে লে’গল।।’

ননদের মৃত্যুতে সহানুভূতির সামান্যতম দিক এখানে খুঁজে পাওয়া যায় না।

       অবশ্য সব সময় ননদের সঙ্গে সম্পর্কে খারাপ সেটা বলা যায় না। যেখানে ননদের সঙ্গে মধুর সম্পর্কে থাকে সেখানে কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারে না। বধূ যখন বাপের বাড়ি যাওয়ার উদ্যোগ নেয়, তখন ননদের চোখের জল বাধা মানে না। গভীর আত্মিক রূপ সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। টুসু গানে এই চিত্রও ফুটে ওঠে –

‘ইন্দু বিন্দু সিন্দুর পরলাম বাপের ঘর যাবার লাগ্যে।

গুণের ননদ কাঁদতে লাগল্য বাস ফুলের ডাল ধরে।।

কাঁদ না কাঁদ না ননদ ফির‍্যে আসব মাঘ মাসে।

দু হাতে দু মিঠাই থালা আন্যে দিব তুমাকে।।

লৌতন দেশের লৌতন শাড়ি আন্যে দিব তুমাকে।’

       পারিবারিক জীবনে সপত্নীর যন্ত্রণা অধিকতর। কোন মেয়েই সতীনকে মেনে নিতে পারে না। লোকসাহিত্যের কোন বিভাগেই সতীন সম্পর্কে সুখকর সংবাদ পাওয়া যায় না। টুসু গানে তার ব্যতিক্রম হয় নি। -

‘আয় লো সতীন মারবি ন কি তর কি আমি মার খাব।

কালীর থানে খুঁটি গাড়্যে তকেই বলিদান দিব।।’

কিংবা,

‘এক গাড়ি কাঠ দু গাড়ি কাঠ কাঠে আগুন লাগাব।

যখন আগুন পরগল হবেক সতীনকে ঠেলে দিব।।’

কালী পূজার সময় মায়ের কাছে সতীনকে বলি দিতে চায় কিংবা সতীনের প্রতি এতটাই বিদ্বেষ জন্মায় যে একাধিক কাঠ একসঙ্গে জ্বালিয়ে দিয়ে যখন আগুন দাউ দাউ করে জ্বলবে, তখন সতীনকে সেই আগুনে ফেলে মেরে ফেলবে। নিশ্চিত মৃত্যুর কামনাই মুল লক্ষ্য।

       মায়ের অভাব মেয়েরা বেশি করে অনুভব করে। মা না থাকলে শ্বশুর বাড়ি থেকে সামান্যতম রেহাই পাওয়া যায় না। কারণ মেয়েকে কেউ বাপের বাড়িতে আনার উদ্যোগ করে না। মায়ের অভাব তাই টুসু গানে প্রতিফলিত হয় –

‘মাথা ঘঁষে রইলম বসেঁ প্রাণ জুড়াব কার কাছে।

অকাল কালে মা মরেছে আর আমাদের কে আছে।।’

সমস্ত বেদনা, দুঃখে সান্ত্বনা পাওয়া যায় মায়ের কাছে। সেই মা যদি না থাকে সন্তানের প্রাণে সান্ত্বনা দেবার কেউ থাকে না। মনের দুঃখ মনের মধ্যেই থাকে। এইভাবে কেটে যায় সারাটা জীবন।

       টুসু গান মেয়েদের গান। স্বাভাবিকভাবে মেয়েদের নিজস্ব সত্তার দিকগুলো টুসু গানে প্রকাশিত হয়ে থাকে। টুসুকে কখনও ছেলে হিসেবে কল্পনা করে মাতৃত্বের সুখস্বপ্নে বিভোর থাকে। তারও প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। নারী জীবনের কিশোরী লগ্ন থেকেই আমৃত্যু পর্যন্ত নানা ঘটনার প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়ে থাকে এই টুসু গানে। সেই প্রেক্ষাপটে আর্থ সামাজিক দিকটিও উন্মোচিত হয়। যাই হোক, বর্তমান আলোচনায় টুসু গানের সামগ্রিক দিক নিয়ে আলোচিত হয় নি। কেবলমাত্র বিবাহিতা নতুন বধূর সঙ্গে বাপের বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ির বেদনাতুর সম্পর্কের দিকগুলি উল্লিখিত হয়েছে। নারী হৃদয়ের সার্বজনীন রূপটি কতটা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত রয়েছে – তার খণ্ড ছবি টুসু গানের মধ্যে দিয়ে উল্লিখিত হল।

No comments

Powered by Blogger.