Header Ads


 

আজকের ভাবনা: বিষয় ঝুমুর - ড. পরিতোষ মাহাত

 

আজকের ভাবনা: বিষয় ঝুমুর

ড. পরিতোষ মাহাত

    বাংলা লোকসংস্কৃতির জগৎ এক বিশাল পরিধি নিয়ে বিরাজমান।এর বৈচিত্র্যও লক্ষ্য করার মতো। কোন কোন বিশেষজ্ঞ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় দুটো শ্রেণির অস্তিত্ব খুঁজে পান। প্রথমত, আধিপত্যবাদ এবং দ্বিতীয়ত, পা-চাটাবাদ। বলাবাহুল্য, প্রকৃত লোকসমাজের অবস্থান এই দুই শ্রেণির মধ্যে ধরা যাবে না। লোকসংস্কৃতির প্রকৃত ধারক এবং বাহকেরা কখনই ‘ব্যাণ্ড’ তৈরি করে অস্তিত্বের জানান দেয় না।

    দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষজনকে তাই ধর্তব্যের মধ্যেই আনা যায় না। প্রথম শ্রেণির আধিপত্যবাদীরা বেশ নাক উঁচু। কোনটা ‘লোক’ বা ‘ফোক’ – গলা জাহির করে তারা বেশ ফলাও করে বলে বেড়ায়। তারা ব্যাকরণের শুদ্ধাশুদ্ধ বিচারের ভার নিয়ে ‘ফোকে’র পিঠের চামড়া খুলে ঢাক বানায়। নিজের ঢাক নিজে বাজায় বেশি। দাবড়ানিটাও প্রায় একরোখা দামড়ার মতো। সত্যি বলতে কি কথায় কথায় এক্তিয়ার বহির্ভূত বিষয়ে নাক গলাতে গিয়ে অনেকের নিজেদের নাক এতটাই লম্বা হয়ে গিয়েছে যে এদের বলতে হয় এরা সবাই যে যার হাতে সাড়ে তিন হাত। শুন্য কলসি বা ফোঁপরা ঢেঁকির আওয়াজ বেশি – এটা এদের কে বোঝাবে? ঢোল, মাদল আর ধমসার তফাৎ বোঝে না অথচ লোকসংস্কৃতির দোকান খুলে বসে আছে। এমন গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়লদের হামেশাই দেখা যাচ্ছে। একমাত্র আকল বইসা হাথের গুড়দানি পড়লে এদের যাবতীয় ফড়ফড়ানি চিৎপটাং হতে বাধ্য।


    জসিমুদ্দিন সাহেব একবার মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগুলির অস্তিত্ব আদৌ ছিল কিংবা আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন এঁকে দেন। সলিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথ ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে তিনি আবিষ্কার করেছেন এমন উদ্ধৃতি যেখানে সাঁওতালদের জাতীয় উৎসব বাঁধনা দেখতে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। একটা ওয়েবসাইটে দেখলাম জ্বল জ্বল করছে মহুল নাকি ‘extract of mahua fruits.’ (!)। বাঁশ বনে শিয়াল রাজার মতো আধুনিক (?) লোকেদের তৈরি লোকসংস্কৃতির জগতে কত বিচিত্র বিস্ময় অপেক্ষা করছে তা কি বলে শেষ করা যাবে ? যারা ‘মহুল’ আর ‘কচড়া’-র ফারাক বোঝেন না তাদের হাতে ঝুমুরের কি দশা হবে বুঝতেই পারছেন। বোধহয় লোকসংগীতের ক্ষেত্রে ঝুমুরের ওপরেই বেশি দাঁত-নখের আঁচড় পড়েছে। আমাদের তো তাই মনে হয়। খোদ জনম আখড়াতে একটা কঠিন ‘রা’ তৈরি হয়েছে বলে হাওয়ারাচা লেগেছে অন্য জায়গায়। ড্রইংরুমবিলাসি বাজারপ্রিয় লোকশিল্পীরা(?) এখন ক্যাসেট-সিডির গা থেকে ঝুমুর কথাটা খুলে নিচ্ছে। নাগরিক সংস্কৃতির কৃপাধন্য হতে চেয়ে তবলায় বেশ ধাম-ধাতাম করে, না হলে ইলেকট্রনিক্স অরগ্যান, সিন্থেসাইজার, প্যাডের ঢিনচাক লাগিয়ে নবীনতর হালফিল লেবেল ‘আঞ্চলিক গান’। বোঝো ঠ্যালা! ঝুমুরের ওপর এই নাগরিক নিপীড়নের শুরুয়াৎ কি কিছু বিদগ্ধ গবেষকদের হাতে? যেমন, আশুতোষ ভট্টাচার্যের সংগৃহীত ঝুমুরের নিদর্শন: “মোহনপুরে ঠেকাঠেকি কি করে শুড়াব একা/ টিকটিকি ননদ পালাল/ খোঁচার মোহন খোঁচে শুকাল।” – ইত্যাদি। এই গানের আসল রূপটা এখানে দেওয়া হল – তুলনা করলেই বুঝতে পারবেন, পণ্ডিতে কী না পারেন – মহুল পড়ে ঠেকা ঠেকা/ কি করেঁ কুঢ়াব একা/ টিকটিকি দেখেই ননদ পালাল্য/ খঁচের মহুল খঁচেই শুখাইল’ …ইত্যাদি। ঠেকা কথার অর্থ ঝুড়ি। বহুত্ববাচক বচনে শব্দটি দু’বার ব্যবহার করা হয়েছে। এটি এই অঞ্চলের ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। চর্যার যুগেও এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ঠেকা শব্দ যার অপরিচিত তিনি ঠেকা ঠেকা-র স্থানে ঠেকাঠেকি লিখে চালিয়ে দিলেন। মহুল হয়ে গেল মোহন। খঁচের হয়ে গেল খোঁচা।

    আধিপত্যবাদীদের হাতে চ্যানেল আছে। বাকি সব শিশুরা হাঁ করে সেই সব ললিপপ চাটছে। আর আমরা যখন এই সব চ্যানেল থেকে ‘একদিনকার হলুদ বাঁটা তিনদিনকার বাসি’ কিংবা ‘কাদা দিলি সাদা কাপড়ে’ শুনি – তখন আঁতকে উঠি। ভয় হয়। অস্তিত্বেরই ভয়। এভাবে টিকে থেকে বেঁচে থেকে আদৃত হয়ে কী লাভ? আসল ঝুমুর তো ‘বনে ফুটে বন মালতী’র মতোই। লোকসংস্কৃতির প্রবহমান ধারা কারো পৃষ্ঠপোষকতার অপেক্ষায় থাকে না। এর প্রাণের কথা, আত্মার কথা ‘পেটে নাই যার দানা পানি/ সে কি বলে ভাই ঝুমুর শুনি’ –মোটেই নয়। এর আসল theme হল ‘হামরা ভখে মরি/ হামরা শসে মরি/ ঝুমইরাকে লিঞে যাব কাঁধে করি।’ অশিক্ষা, দারিদ্র্য, রাজনীতি কোন কিছুই এর চলার বেগ ও আবেগ রুদ্ধ করতে পারেনি, পারবেও না।

(সূত্র ‘অস্তিত্ব’ পত্রিকা, উলুবেড়িয়া, হাওড়া, ২০১০)

No comments

Powered by Blogger.