Header Ads


 

সানন্দিতা মানসী মিশ্র

 


সানন্দিতা

মানসী মিশ্র

 

কালো মেঘে ভরে উঠেছে আকাশ। চারদিক কেমন যেন চুপচাপ। প্রকৃতি বুঝি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টি একটা নামবেই। নিশা স্কুল ছুটির পর সাততাড়াতাড়ি করে বাস স্ট্যান্ডে আসে। রিক্সাওয়ালাকে বলে – ভাই একটু তাড়াতাড়ি চল, চালতা তলা যাব। শাড়ি ঠিক করে কোলের ওপর ব্যাগ রেখে বসে নিশা। মাথার ভেতর চিন্তার পোকাগুলো বিজবিজ করছে – সায়নের আজ আসার কথা। কিন্তু ওর যা মন আসবে কিনা কে জানে। অন্তত পক্ষে আজকের দিনটা ওর আসা উচিত। বলেছি আসার সময় সানিকে হোস্টেল থেকে নিয়ে আসতে। কি যে করছে কে জানে।

রিক্সাওয়ালাকে বলে – কি হল ভাই, তাড়াতাড়ি চল, এখুনি বৃষ্টি আসবে। আবার নিজের মনে মনে বক বক করতে থাকে নিশা – সায়ন যদি না নিয়ে আসে। না না সায়ন এত ভুল করবে না। বাড়ির কাছে আসতেই নিশা রিক্সা থেকে নেমে সোজা বাসায় ঢোকে।

‘সা-নি-’ মেয়েকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢোকে সে। সায়নকে দেখে ময়ূরীর মতো নেচে ওঠে নিশার মন। সে বলে – ‘কখন এসেছ সায়ন? সানি কোথায়?’ সায়ন কেমন যেন বিস্মিত হয়ে যায়। সে বলে ‘সানি তো হোস্টেলে।’ নিশার ময়ূরী মনে এবার মেঘের গর্জন শোনা যায়। - ‘তোমাকে যে বলেছিলাম আসার সময় সানিকে নিয়ে আসবে।’ অপরাধীর মত সায়ন বলে ওঠে, - ‘তুমিই তো প্রতি শনিবার ওকে নিয়ে আস, তাই আমি ভাবলাম…’

‘তুমি আমার মাথা ভেবেছ। কাল সানির জন্মদিন। আজ আমার কত কাজ। কত করে ফোন করে বললাম আসার পথে সানিকে নিয়ে আসবে।’ – দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিশা। ‘আচ্ছা, আমি যাচ্ছি’ বলে রেডি হয় সায়ন। বিদ্যুৎবাণ নিক্ষেপ করে নিশা বলে – ‘তুমি কেন যাবে? আমার মেয়ে আমাকে যেতে হবে। সারা স্কুলের স্টাফের কাছে আমাকে অপমানিত হতে হয়। সবাই বলে – আপনি নাকি ভালবেসে বিয়ে করেছেন। তবু আপনার স্বামী সপ্তাহে সপ্তাহে মাসে মাসে আসেন।’ ক্রোধ আরও বেড়ে যায় নিশার। রাগের মাথায় সে বলে, - ‘ঘেন্না হয় তোমার মত একটা পুরুষকে ভালবাসি ভাবলে।’ – দু’চোখে অশ্রুর বন্যা নামে নিশার।

সায়নের করুণ চোখ উত্তর দেয়, ‘বিয়ের আগেই তোমাকে বলেছিলাম আমার মাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। আর এমন কোন রোজগার করি না যাতে সবাইকে নিয়ে বাইরে ভাড়া বাড়িতে থাকব। আমি চাই না আমার স্ত্রীর রোজগারে আমার মাকে থাকতে দেব।’

দু’গাল ভরা চোখের নোনতা জল নিশার ঠোঁট ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সানিকে নিয়ে আসার জন্য বের হয় সে।

সায়ন বাধা দেয়। সে বলে, - ‘আমার ভুল হয়ে গেছে। এবারের মত ক্ষমা কর। আমি সানিকে আনতে যাচ্ছি।’ কোন কথা শোনে না নিশা। বেরিয়ে যায়। শুরু হয় বজ্রপাতসহ বৃষ্টি।

নিশার বাড়ি থেকে সানির হোস্টেল দু’ঘণ্টার পথ। নিশা বেরিয়েছে সেই তিনটায়। রাত্রি দশটা বাজতে যায়। নিশা ফিরছে না দেখে ছটফট করে ওঠে সায়ন।

বৃষ্টি আরও জোরে পড়ছে। বাইশ বছরের দামাল প্রেমিক সায়ন আজ বত্রিশে এসে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। মাথার ভেতরের স্নায়ুগুলো সব যেন এক জায়গায় এসে জটলা পাকাচ্ছে। কোথায় গেল নিশা? এত দেরি হওয়ার তো কথা নয়। হোস্টেলে ফোন করে সায়ন। হোস্টেল সুপার জানায় – বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সানিকে নিয়ে নিশা বেরিয়ে গেছে।

অসহ্য যন্ত্রনায় মাথার চুলগুলো চেপে ধরে সায়ন। সানির জন্য বুকের ভেতরটা গুমরে ওঠে। দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারটা ঘণ্টা পড়ে। চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে সায়ন।

-‘দরজা খুলুন দিদিমণি দরজা খুলুন’

বাইরের চিৎকারে জেগে ওঠে সায়ন। সূর্যের রক্তিম আলো এসে চোখে পড়েছে তার। পাখিরা কিচিরমিচির ডাকছে। শুদ্ধা স্নানরতা পৃথিবী আজ যেন কত সুন্দরী।  সায়ন বুঝতে পারে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা নিজেই জানে না। হঠাৎ মনে পড়ে নিশা এখনও ফেরে নি। সানির জন্য মন ছটফট করে ওঠে।

‘দরজা খুলুন দিদিমণি, দরজা খুলুন।’ – আবার চিৎকার। সায়ন দরজা খুলে দেখে বাইরে অনেক লোকজন। তাদের কেউ সব্জি, কেউ মিষ্টি, কেউ বা ফুল নিয়ে উপস্থিত। সায়নের মনে হয়, আজ সানির জন্মদিন। লোকজন যে যার কাজে লেগে যায়। রাঁধুনিও রান্নার কাজ শুরু করে। সায়ন শুধু রুমে পায়চারী করে।

দশটা বাজল। নিশার কলিগরা উপস্থিত। সায়ন তাদের অভ্যর্থনা জানায়। হঠাৎ সানির ‘বাবা’ ডাকে ফিরে তাকায় সায়ন। ছুটে গিয়ে সানিকে কোলে তুলে নেয়। সানি তার কচি কচি হাত বাবার দু’গালে রেখে বলে, - ‘জানো বাবা, কাল রাতে আমরা ছোট দাদুর বাড়িতে ছিলাম। সেখানে খুব মজা করেছি।’ বাবার কানের কাছে মুখ রেখে সানি বলে, - ‘বাবা দেখ মায়ের সঙ্গে কে এসেছেন। উনি সাহিত্যিক।’

সায়ন দেখে বিশিষ্ট সাহিত্যিক অরুণ ঘোষ এসেছেন। নিশা খুব যত্ন সহকারে তাঁকে আপ্যায়ন করছে। সব গেস্টের মুখে মিষ্টি হাসি। সায়ন তাকিয়ে থাকে নিশার দিকে। অনেকদিন পর নিশাকে খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে। হলুদ রঙের তাঁতের শাড়িটায় বেশ মানিয়েছে ওকে। সেই হাল্কা একটা খোঁপা। আর কোন সাজের আড়ম্বর নেই। অথচ নিশা … ভাবনায় ডুবে যায় সায়ন।

হঠাৎ নিশার গলার আওয়াজে চেতনা ফেরে সায়নের। নিশা বলতে থাকে, ‘আমি আপনাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজেই দেরি করে এলাম। প্লিজ, কিছু মনে করবেন না। আসলে আজ শুধু আমার মেয়ে সানন্দিতার জন্মদিন-ই নয়, আজ আমার স্বামী সায়ন মিত্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সানন্দিতা’ প্রকাশ করব বলে আপনাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আমাদের বিশিষ্ট সাহিত্যিক অরুণদার হাত দিয়ে এই বই প্রকাশ করব বলে ওনাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেল। আশা করি আপনার আমাকে ক্ষমা করবেন।’

সবাই জোরে হাততালি দিল। অরুণ ঘোষ প্রথমে প্রদীপ জ্বালালেন। তারপর ‘সানন্দিতা’ প্রকাশ করলেন। এক অদ্ভুত আনন্দের সাড়া পড়ে গেল সারা রুমে। কেক কেটে সানির জন্মদিন পালন হল।

তখনও সায়নের কোলে রয়েছে সানি। নিশা এক কপি ‘সানন্দিতা’ এনে সায়নের হাতে দিল। সায়ন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নিশা বলে, ‘তোমার পুরানো ডায়েরি থেকে কবিতা বেছে বেছে এই বই বের করেছি। তুমি যে কত ভালো কবিতা লেখো, তুমি নিজেও জানো না। দেখবে তোমার অনেক নাম হবে।’

নিশার চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠে। সানি তখন বাবার হাত থেকে বইটা নিয়ে পাতা ওলটাচ্ছে। সায়ন শুধু তাকিয়ে থাকে নিশার দিকে।

(অরণ্যলোক পত্রিকার এপ্রিল ২০০৩, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত)


No comments

Powered by Blogger.