প্রসঙ্গ : টুসুগীতে ফুল পাতানো - ড. পরিতোষ মাহাত
প্রসঙ্গ : টুসুগীতে ফুল পাতানো
ড. পরিতোষ মাহাত
গ্রীষ্মের
তপ্ত দিনগুলোতে সূর্যকে মাথার উপর সাক্ষী রেখে যারা জমিতে লাঙল চালায় তারা নেহাতই অখ্যাত
অজ্ঞাত চাষি মানুষ। ঘর্মসিক্ত কলেবর তাদের। কালো মেঘের অঝোর ধারা গায়ে মাথায় মেখে নিয়ে
বৃষ্টিস্নাত মানুষগুলো অহল্যা মৃত্তিকার শরীরে সবুজ সতেজ প্রাণের প্রতিষ্ঠা করে। অতি
সাধারণ এই গ্রামীণ মানুষগুলোর দারিদ্র্যের কষ্ট তবু যেন নিত্য সহচর। কিন্তু কোন দুঃখ
কষ্টই এই সব মাটির বুকে জেগে থাকা মানুষগুলোর হৃদয়ের অঙ্গনকে মাটি করে দিতে পারে না।
সারা বছর ধরে পরিশ্রমের সোনা-ফসলে যখন তাদের মাঠ ভরে যায়, তখন আনন্দের ঝর্ণাধারাও বোধ
করি দু’কুল প্লাবিত করে ছুটে যেতে চায়। বিশেষত পৌষ যখন ডাক দেয় পাকা ফসলে ভরা ডালা
নিয়ে, তখন তারাও মেতে ওঠে আনন্দ উৎসবে। গ্রামীণ লোকসমাজের চিত্রটাই তখন যায় পাল্টে।
কোথাও চলে নবান্ন উৎসব, কোথাও সাগরমেলা, মকর-সংক্রান্তিকেন্দ্রিক পুণ্যস্নান, আবার
কোথাও বা পৌষ মেলা। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় তখন টুসু পূজার আয়োজন ঘরে ঘরে, পাড়ায়
পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে। নতুন ফসল প্রাপ্তির আনন্দ-আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা মানুষগুলোকে
তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বলয়ে আমরা যেন নতুন রূপে আবিষ্কার করি। আসলে এই শাশ্বত ধারা
চিরকাল ধরে প্রবাহিত হয়ে আসছে।
এখন প্রশ্ন
আসতে পারে ‘সংস্কৃতি’ কী আর ‘লোকসংস্কৃতি’-ই বা কী? ‘সংস্কৃতি’ কী? এ নিয়ে কিছু বলতে
গেলে কয়েকজন বিশিষ্ট গুণী মানুষের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গতি থাকে না। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কথা স্মরণ করতে হয়। তাঁর মতে শিল্প-সাহিত্যই সংস্কৃতি। ড. সুনীতিকুমার
চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘সংস্কৃতির হল সভ্যতা তরুর পুষ্প।’ বিশিষ্ট গবেষক Alfred–এর মতে,
‘Culture is the man made part of the environment.’ যাইহোক, এই সংস্কৃতির আবার তিনটি
স্তর। যথা – (১) আদিম নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতির, (২) লোকসংস্কৃতি এবং (৩) নাগরিক সংস্কৃতি।
‘লোকসংস্কৃতি’র সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ ড তুষার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন,
‘লোকায়ত সংহত সমাজের মূলত সমষ্টিগত জীবন চর্যা ও মানস চর্যার স্বতঃস্ফূর্ত সামগ্রিক
কৃতিই লোককৃতি বা লোকসংস্কৃতি (Folklore)।’ অর্থাৎ লোকসাহিত্য, লোককথা, ছড়া, ধাঁধা,
প্রবাদ, লোকসঙ্গীত, লোকধর্ম, লৌকিক উৎসব-অনুষ্ঠান, লোকচিত্রকলা, লোকস্থাপত্য ও ভাস্কর্য,
লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কার, লোকক্রীড়া, লোকঔষধ, লোকাভিনয়, লোকায়ুধ প্রভৃতি সমস্ত কিছু
মিলিয়ে এক সুবিশাল পরিধির মধ্যে লোকসংস্কৃতির প্রকৃত পরিচয় নিহিত আছে।
‘লোকসংস্কৃতি’র
এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ধারা পৌষকেন্দ্রিক উৎসবের চিত্র প্রতিফলিত হয় লোকসমাজের বিস্তৃত
ক্যানভাসে। আর ডাহি, ডুংরি, টাঁড়, নদী, পাহাড়, অরণ্য পরিবেষ্টিত; শীতের শিশিরসিক্ত
মৃত্তিকালগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার মানুষগুলোর ঘরে ঘরে যে টুসুপুজো চলে তারও
মধ্যে আমরা বিচিত্র এক মানস প্রতিমার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠতে দেখি। টুসুপুজোর জন্যে কোন
মন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। কোন ব্রাহ্মণ পুরোহিতও লাগে না। দরিদ্র কৃষকের কুটিরে বেড়ে
ওঠা সবুজ-অবুঝ নারীমনই করে এই দেবীর আরাধনার সমস্ত আয়োজন। পৌষের শীতার্ত রজনী প্রাণের
আবেগে গড়া গানে গানে উষ্ণ ও মুখরিত হয়ে ওঠে। এই গানের পুষ্প মঞ্জরীই নিবেদিত হয় টুসু
নামক লৌকিক দেবীর চরণে।
টুসু গানের
বিষয় পরিধি অনেকখানি বিস্তীর্ণ। একান্ত নিজস্ব প্রেম, বিরহ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার কথা,
রামায়ণ কথা – এমনকি সাম্প্রতিক সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়েও টুসুগানের
মালিকা রচিত ও পরিবেশিত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হৃদয়ের যে উচ্ছ্বসিত আনন্দ নারী-মনকে
প্রাণ-প্রাচুর্যে উচ্ছলিত করে, তারই বেগ ও আবেগে ঋদ্ধ হয়ে গানগুলো তাৎক্ষণিকভাবে রচিত
হয়ে থাকে। নারীর মন স্বভাবতই কোমল ও আবেগপ্রবন। তাছাড়া সহজাত সুকুমার বৃত্তিগুলোর লালন-পালন
তাদের হৃদয়েই সযত্নে হয়ে থাকে। সমাজ-সংসারে তথা পরিবারে যে কল্যাণ, শ্রী ও সৌন্দর্য
আমরা দেখি তার প্রধান কর্ত্রী নারীরা। টুসু উৎসবের দিনগুলোতেও তারা তাই মমত্ব, প্রেম,
স্নেহ, ভালোবাসার উজাড় করে দিয়ে পরিবারে ও সংসারে শান্তির বাতাবরণ গড়ে তোলার চেষ্টা
করে। এই মমত্ব, ভালোবাসার দিয়ে গড়া টুসু উৎসবের একটি বিশেষ অঙ্গ হল ‘ফুল পাতানো’। টুসু
উৎসব বা টুসু মেলাকে মিলনের আনন্দে পরিপূর্ণতা দেওয়ার প্রয়াস এই হার্দিক উষ্ণতার পারস্পরিক
বিনিময়ে। একটি মেয়ে অপর একটি মেয়ের সঙ্গে সখীত্বের তথা বন্ধুত্বের সম্পর্কে স্থাপন
করে ফুল পাতানো অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। এই সম্পর্ক পরবর্তীকালে সারা জীবন অটুট থাকে।
একান্ত পরম আত্মীয় হয়ে ওঠে পরস্পর। পরকে একান্ত আপনার করে নেওয়ার মধ্যে নিঃসন্দেহে
তাদের আন্তরিক ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সমস্ত বিশ্ব-সংসারকেও যেন বন্ধুত্বের অটুট
বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্যে তাদের কণ্ঠে উৎসারিত হয় উথলিত হৃদয়ের কথা। -
“গাড়ি আইল হুদা হুদা
ও গাড়োয়ান তর ঘর কুথা।
সুজন দেখে ফুল পাতাব
ঐ যে রাস্তা কইলকাতা।।”
কিংবা, -
“সরডিহার সরু চিড়া
লাউদহতে ভিজাব।
রহনী গাঁয়ের ছঁড়ির সঁগে লো
সুরগুঁজা ফুল পাতাব।।”
আরও একটি
টুসু গীতে দেখি একটি মেয়েকে, যা কিনা তার মাকে তার মনের কথা খুলে বলেছে – সে ফুল পাতানোর
জন্যে সরলা নামের মেয়েটিকে বেছেছে। ঐ মেয়েটিকে তার ভালো লেগেছে। ভালো লাগার কারণ তার
হেঁটে আসার ভঙ্গিমা এবং সেই হাঁটা অবশ্যই টুসুর মাথায় ফুল দেওয়ার জন্যে। ভালো লাগার
থেকেই তো ভালোবাসার সূচনা। গানটি এই –
“ও মা আমি ফুল পাতাব
পাহাড় ধারের সরলাকে।
হেলেদুলে আসছে সরলা
টুসুর মাথায় ফুল দিতে।।”
শুধু ফুল পাতালেই তো হল না। এরই সঙ্গে কিছু
প্রীতি ও শুভেচ্ছার স্মারক হিসেবে উপহার না দিলে তো মন ভরে না। তাই মেয়েটি আবার গেয়ে
ওঠে –
“মাগো মাগো ফুল পাতাব
ফুলকে আমার কি দিব।
ঝাঁড়গা বাজারলে আনে
ফুলকে ফুলাম তেল দিব।।”
বিশ্ব জুড়ে যখন হিংসা, যুদ্ধ, হানাহানি চলছে,
তখন আমরা তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা মুখে শ্লোগান দিই ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’। কিন্তু
আমরা এতটাই নাক উঁচু যে সমাজের অতি সাধারণ নিরক্ষর প্রায় অশিক্ষিত মানুষগুলোর মধ্যে
প্রেম-ভালোবাসা-বন্ধুত্বের যে অমৃত-ফল্গুধারা বয়ে চলেছে তার খোঁজ রাখি না। প্রেম-ভালোবাসা-বন্ধুত্ব
এইগুলিই তো দেশে, সমাজে হিংসা ভুলিয়ে শান্তি আনতে পারে। লোকসংস্কৃতির এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ
দিক হল টুসু পুজো, টুসু মেলা। মেলা আর মিলন যে সমার্থক তার এমন প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত
আর কী আছে? নাকে রুমাল চেপে নয় মুখে সত্যবাণী আর বুকে অপরিসীম আশা নিয়ে লোকসংস্কৃতির
চর্চা করতে এলে আমরা সভ্যতা-সংস্কৃতির উন্নতি প্রত্যাশীরা যে অনেক লাভবান হতে পারি
তা মনে-প্রাণে অনুধাবন করার সময় এসেছে।
তথ্য সহায়ক –
(১) পশ্চিমাঞ্চল লোকশিল্পী
সংঘের শিল্পী বন্ধুগণ
(২) ড. তৃপ্তি ব্রহ্ম –
‘লোকজীবনে বাংলার লৌকিক ধর্ম সঙ্গীত ও ধর্মীয় মেলা’
(৩) ড. সুধীর করণ – ‘দক্ষিণ-পশ্চিম
সীমান্ত বাঙলার লোকযান’
(৪) ড. বিনয় মাহাত – ‘লোকায়ত
ঝাড়খণ্ড’
(৫) ড. তুষার চট্টোপাধ্যায়
– ‘লোকসংস্কৃতির তত্ত্বরূপ ও স্বরূপ সন্ধান’
(অরণ্যলোক পত্রিকার এপ্রিল ২০০৩, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত)
No comments