Header Ads


 

বিস্মৃতপ্রায় উপন্যাসঃ চন্দ্রনাথ বসুর ‘পশুপতি সম্বাদ’ (প্রথম পর্ব) - ড.পরিতোষ মাহাত


বিস্মৃতপ্রায় উপন্যাসঃ চন্দ্রনাথ বসুর ‘পশুপতি সম্বাদ’ (প্রথম পর্ব) - ড.পরিতোষ মাহাত  

[বাংলা উপন্যাসের দেড়শ বছরের আলোচনায় বিদগ্ধ মহলে একবার আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে প্রকাশিত ‘পশুপতি-সম্বাদ’ নামক বিস্মৃতপ্রায় উপন্যাসটির প্রতি আলোকপাতের প্রয়াসেই এই প্রবন্ধের অবতারণা।...আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত দিকভ্রষ্ট বিভ্রান্ত বিমূঢ় নায়ক পশুপতি যেন আধুনিক সুসভ্য নাগরিক জীবনের প্রতিনিধি। যুগের অস্থিরতার আবহাওয়ায় উদগ্র দেশপ্রেমের উন্মত্ততা গ্রাস করার ফলে জীবনের কী পরিণতি হতে পারে ঔপন্যাসিক চন্দ্রনাথ বসু তাঁর এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন। নীতিহীন আদর্শভ্রষ্ট বক্তৃতাবাগীশ পশুপতির চরিত্র উদঘাটন অনবদ্য।...প্রথম পর্ব...]

১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ৩১ আগস্ট হুগলী জেলার রামপুরা মহকুমার হরিপাল থানার অন্তর্গত কৈকালা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন চন্দ্রনাথ বসু। তাঁর পিতার নাম ছিল সীতানাথ বসু। ইংরেজী ভাষা শেখার উদ্দেশ্যে তাঁকে পাঁচ বছর বয়সে শিমলা বাজারের কাছে হেদোর স্কুলে ভর্তি করা হয়। ৬ মাস ইংরেজী শেখার পর ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে পাঠ শুরু করেন। সেখান থেকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং প্রেসিডেন্সী কলেজে উচ্চশিক্ষা শুরু করেন। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে বি. . পাস করেন। ১৮৬৬-তে ইতিহাসে এম.. এবং ১৮৬৭-তে বি. . ডিগ্রী অর্জন করেন। আইনের ডিগ্রী থাকলেও তিনি অবশ্য কখনো আইনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন নি।

‘Calcutta University Magazine’ নামক ইংরাজী মাসিক পত্রে সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রথম চাকুরী সরকারের ‘শিক্ষা বিভাগে’। তাঁর উচ্চশিক্ষা ও অগ্রসর চিন্তাধারার স্বীকৃতিতে সরকার তাঁকে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে একজন মনোনীত ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু আমলা জীবন তাঁর স্বভাবের অনুকূল ছিল না। ছয় মাস পরেই এই পদ থেকে তিনি অব্যাহতি নেন। যোগ দেন কলকাতার জয়পুর কলেজের অধ্যক্ষের পদে। জয়পুর কলেজ ছেড়ে ১৮৮৭-তে বেঙ্গল গভর্ণমেন্টের অনুবাদকের পদে যোগ দেন। তখন এই পদ প্রথম শ্রেনিভুক্ত ছিল। এছাড়াও তিনি বেঙ্গল লাইব্রেরীর অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেছিলেন। এটি দেশের প্রথম সরকারী প্রতিষ্ঠান ছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার পুরস্কারস্বরূপ চন্দ্রনাথ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি হন (১৮৯৬) এবং পরের বছর সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত হন। স্মরণ্য, ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত (আই. সি. এস.) এবং যৌথ ভাবে সহ-সভাপতি হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নবীনচন্দ্র সেন।

বাংলা সাহিত্য জগতে চন্দ্রনাথ বসু অপেক্ষাকৃত স্বল্পালোচিত সাহিত্যিক। প্রথম জীবনে তিনি ইংরেজী ভাষায় লেখালেখি শুরু করলেও পরে বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ দেখা যায়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহচর্যে ও প্রভাবে বাংলা সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ ছাড়াও গিরিশচন্দ্রের ‘Bengalee’, অক্ষয়চন্দ্রের ‘নবজীবন’, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতী’, ‘নব্য ভারত’, ‘প্রচার’ প্রভৃতি সাময়িক পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি হল – ‘শকুন্তলা-তত্ত্ব’ (১৮৮১), ‘পশুপতি সম্বাদ’ (১৮৮৪), ‘ফুল ও ফল’ (১৮৮৫), ‘হিন্দু বিবাহ’ (১৮৮৭), ‘ত্রিধারা’ (১৮৯১), ‘হিন্দুত্ব’ (১৮৯২), ‘কঃ পন্থা’ (১৮৯৮), ‘বর্তমান বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রকৃতি’ (১৮৯৯), ‘সাবিত্রীতত্ত্ব’ (১৯০০), ‘সংযম শিক্ষা বা নিম্নতম সোপান’ (১৯০৪) ও ‘পৃথিবীর সুখ-দুঃখ’ (১৯০৯) প্রভৃতি।[৩] ‘শকুন্তলা-তত্ত্ব’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। ‘হিন্দু বিবাহ’, ‘হিন্দুত্ব’ ইত্যাদি রচনায় তিনি রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। কারো কারো কাছে মননশীলতায় তিনি বঙ্কিমানুসারী, হিন্দু ধর্মের মহিমা রক্ষায় ব্রতী। ‘শকুন্তলা-তত্ত্বে’ তিনি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলমে’র বিস্তৃত সমালোচনা করে সাহিত্য-সমালোচকরূপে সমধিক সুখ্যাতি লাভ করেছেন। কালিদাসের কাব্য নিয়ে এ জাতীয় দার্শনিক আলোচনা বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম তিনিই করেছেন। ‘ফুল ও ফল’ এবং ‘বর্তমান বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রকৃতি’ প্রভৃতি সাহিত্য বিষয়ক রচনায় তাঁর যুক্তিবোধ, বিচার-বিশ্লেষণে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অসাধারণ মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। উৎকৃষ্ট রসরচনার বিচারে ‘ত্রিধারা’র অনেক প্রবন্ধ প্রশংসার যোগ্য।

সুদীর্ঘ দেড়শ বছরের বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, উপন্যাস রচনার শুরুর কাল ঊনবিংশ শতক থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত অনেক উপন্যাস রচিত হলেও আজকের দিনে সব উপন্যাস পঠিত হয় না বা আলোচিত হয় না। অথচ কিছু উপন্যাস এক সময় বাংলার পাঠকসমাজে প্রভূত সাড়া ফেলেছিল। জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল কিংবা আলোচনা-সমালোচনার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। আবার কারো কারো উপন্যাস সমকালেও সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণে অসমর্থ হয়ে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। বিঙ্কিম যুগের এমনই কিছু ঔপন্যাসিক ও তাঁদের রচিত গ্রন্থের নাম এখানে স্মরণ করা হল। অম্বিকাচরণ গুপ্তের ‘কপট সন্ন্যাসী’ (১৮৭৪), ‘শান্তিরাম’ (১৮৮৫), ‘সংসার সঙ্গিনী’ (১৮৮৫), ‘পুরাণ কাগজ’ (১৮৯৯); কালীকৃষ্ণ লাহিড়ীর ‘রশিনারা’ (১৮৬৯); ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তীর ‘চন্দ্রনাথ’ (১৮৭৩), ‘মুরলা’ (১৮৮০), ‘মধুযামিনী ও কৃষ্ণ’ (১৮৮৫); চণ্ডীচরণ সেনের ‘মহারাজ নন্দকুমার’ (১৮৮৫), ‘দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ’ (১৮৮৬); জয়গোপাল গোস্বামীর ‘শৈবলিনী’ (১২৭৬ বঙ্গাব্দ), তারকনাথ বিশ্বাসের ‘গিরিজা’ (১৮৮২), ‘সুহাসিনী’ (১৮৮২), ‘কমলা’ (১৮৮৩); রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘রাজবালা’ (১৮৭০); পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মধুমতী’ (১২৮০ বঙ্গাব্দ); দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরীর ‘বিরাজমোহন’ (১৮৭৮), ‘ভিখারী’ (১৮৮১) প্রভৃতি।[৪] 

মানুষের সামাজিক জীবন, জীবনের সমস্যা, তার স্বপ্ন আশা আর হতাশা, তার ব্যক্তিত্ব কিংবা অনিবার্য পতন পদস্খলন নিয়ে কোন কোন ঔপন্যাসিক অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু সেই বিষয়ে সাহিত্যতাত্ত্বিকগণ আলোকপাত করেননি। সুলেখক, বিদগ্ধ পণ্ডিত, গবেষক, সাহিত্যিক চন্দ্রনাথ বসু রচিত ‘পশুপতি সম্বাদ’ (১৮৮৪) এমনই একটি উপন্যাস। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত দিকভ্রষ্ট বিভ্রান্ত বিমূঢ় নায়ক পশুপতি যেন আধুনিক সুসভ্য নাগরিক জীবনের প্রতিনিধি। যুগের অস্থিরতার আবহাওয়ায় উদগ্র দেশপ্রেমের উন্মত্ততা গ্রাস করার ফলে জীবনের কী পরিণতি হতে পারে ঔপন্যাসিক চন্দ্রনাথ বসু তাঁর এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন। নীতিহীন আদর্শভ্রষ্ট বক্তৃতাবাগীশ পশুপতির চরিত্র উদঘাটন অনবদ্য।  কাহিনীর ঋজুগতি অনুপম। গঠন বিন্যাস আকর্ষণীয়। তাঁর উপন্যাসের ভাষা প্রাঞ্জল ও প্রসাদগুণ সম্পন্ন। রচনারীতি সহজ গতিশীল। তির্যক ব্যঙ্গের শাণিত বাগবিন্যাস এই গ্রন্থের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক। কালের নিয়মেই হোক বা বঙ্কিমচন্দ্রের অসাধারণ সব উপন্যাসের দ্যুতিময় বর্ণচ্ছটার কারণে চন্দ্রনাথ বসুর এই উপন্যাস আমাদের দৃষ্টিলোকের আড়ালে থেকে গেছে। বাংলা উপন্যাসের দেড়শ বছরের আলোচনায় বিদগ্ধ মহলে একবার আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে প্রকাশিত ‘পশুপতি-সম্বাদ’ নামক বিস্মৃতপ্রায় উপন্যাসটির প্রতি আলোকপাতের প্রয়াসেই এই প্রবন্ধের অবতারণা। (পরবর্তী পর্বে পড়ুন...)

তথ্যসুত্রঃ

(১) শামিমা আক্তার; বসু, চন্দ্রনাথ; www.bn.banglapedia.org  (site accessed on 6th March 2017)
(২) শামিমা আক্তার, তত্রৈব
(২) পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য; ‘সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিচয়’; জয়দুর্গা লাইব্রেরী, কল- ৯; মার্চ ২০১২; (ISBN : 978-93-81680-09-4); পৃঃ - ১৭৫
(৩) পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য; তত্রৈব;  পৃঃ - ১৫৯

No comments

Powered by Blogger.