রাইত গেল পাছে - নিমাই দত্ত
অরণ্যলোকের গল্প:
রাইত গেল পাছে
ঘুম আসছেনা ঝলকির। আমের বোলের আর কাঁঠালের মুচির গন্ধে রাত্রি বেলার ফাগুনের হাওয়া। ঝলকির মাটির বাড়ির অদূরে দিগন্ত প্রসারী মাঠ, - মহুলবনির মাঠ। সেখান থেকে ভেসে আসছে মহুয়ার তীব্র মিষ্টি গন্ধ। বসন্তের এই সব মাতাল করা রাতে বুকটা বড় হায় হায় করে ওঠে। কিন্তু কিসের জন্য যে তা বোঝা যায় না।
মহুলবনি গ্রামের গরীব ঘরের মেয়ে সে। গ্রামে গঞ্জে গতর খাটা মসুরের কাজ কম। তাই তার বাপ এক অঘ্রাণে পাশের গায়ে মধু খুড়া পরিবারের সঙ্গে বড়, মেয়েকে নিয়ে নাবাল খাটতে গেছল। ঝলকির তখন বয়স নয়, জঙ্গল পেরিয়ে সগড়ভাঙ্গার স্কুলে যেত, পড়ত তৃতীয় শ্রেণীতে।
ভাবতে থাকে সে। কি উত্তেজক, আর বেদনা বিজড়িত স্মৃতি। খড়গপুর থেকে জীবনে প্রথম রেলে চড়া। মাদপুর স্টেশনে নেমে আলপথ দিয়ে যাত্রা। দুধারে ধানের ক্ষেত। শীতের হিমেল হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে নো গ্রামের এক সম্পন্ন চাষীর চালাঘরের দাওয়ায় চোদ্দজনের সঙ্গে পেট পুরে গরম ভাত খাওয়া, চাটার বিছানায় মায়ের শরীরের ওমে গভীর নিদ্রা।
কিন্তু গরম ভাতের গন্ধ, মায়ের শরীরের উত্তাপ, কাটা ধানের ক্ষেতে আর পাঁচটা ছেলের সঙ্গে কাটা ধানের পড়ে যাওয়া শিষ সংগ্রহ, অবসরে খানা ডোবায় গেঁড়ি, গুগলি , চুনো–পুটি, পাঁকাল আর চ্যাং মাছ ধরা ; মাঝে মধ্যে গান বেঁধে সমস্বরে গাওয়া ‘পালাঁই গেল, পুচকে গেল সাধের চ্যাংটা’, বেশী দিন স্থায়ী হল না।
ভোর সকালে জলঘাট যাঁইছিল বাপে। জলশোচ কইরতে যাতেই কালখরিসে দংশাল। মেদিনীপুর হাসপাতালে লেগেছিল বাবুরা – মড়াটা , বাঁচে নাই। বাপের মুখটাও ত আজ মনে কইরতে পারে না। কেবল মনে পড়ে, বাপ ঘরে আস্যেই তাকে হেঁচকাই তুলত বুকের উপর। খোঁচা খোঁচা দাড়িটা তার গালে ঘসে দিয়ে বইলত্য, বিটির চোখ দুটা ঝলকাছে আগুনের পারা। কোলের ছানাটা চিলবিলাই উঠে , স্বপন দেইখ্যে থাকবে হয়ত। বাইসাম বেলা সনার মা বুড়ি আইসেছিল, ঠিকরাই দিয়ে গেছে পাছে। সারা বেলা চেচরা গালবেক। সকাল হলে মুকুন্দ বুড়ার কাছে নুন পড়া’ আনতে হবে।
বুকের দুধ নেই। তবু পাশ ফিরে কোলের কাছে টেনে নেয় ছেলেকে। বাইগন পুড়ার মত চুপসান একদলা মাংসখন্ড ঠেসে ধরে ছেলের মুখে। সে চুষে, আঁচড়ায়, কামড়ায়, গুঁতোয় আর চেচরা গালে। ঝলকির মনটা খারাপ হয়ে যায়। বলে, কি কইরব বার বছরে জুয়ান হলি। গাঁয়ের মাতব্বর ডাক্যে পাঠাল মাকে। বলল, ‘খালি পাত বিকে যুয়ান বিটিছানাকে আর কতদিন পালবি? বেহা দিতে হবেক নাই?’
মার মুখে রা
নাই। কি বইলবে অতবড়
বাবুর সামনে? তৎলে বইলল, ‘বর ত লাগে নাই।’ হেসে
উঠল বড় মাহাত। বলল, ‘আমার ভাতুয়া লবকে দেখেছিস
ত? উয়ার সঙ্গে দিয়ে দে সামনের লগনে। খরচ খরচা
আমার।’
মা কঁকাই উঠে বইলতে গেল, ‘মাইয়া,
বারঅ যাই তেরয় পা দিয়েছে, আর উয়ার
পাকল বয়স। তা বাকি
নিজের ঘর বসত নাই।’
‘আমি দিব পুখর আড়ায়
ঘর করার জমি। ঝাড়ের বাঁশ,
চাষের খড়। যা দরকার লিয়ে লিবেক।’
বলল বড়
মাহাত।
বেহা হয়ে গেল
বাপ। তের বছর বয়সে। তেইশ পেরায় নাই। পাঁচ ছানার
মা হলি। বুঝতেই পারলি নাই। কেমন কইর্যে সিরাই
গেল বেহালি যৌবন। ছোট ছেলেটা
মায়ের বকবকানিতে শান্ত হয়,
মায়ের কাপড় ভেজায়। ঝলকি ঝাপট দিয়ে উঠে –
‘দিলি ত, কাপড় চাটা ভিজাই। যেমন
বাপ, তেমন বেটা, জ্বালাই
খালি।’
জু এৱ
তিতিক্ষায় লবকে গালাগাল করে সে
ভাবতে থাকে। লব তথা নবকুমার
প্রথম যৌবনে তার খুবই মনপসন্দ ছিল। মায়ের অপসন্দ ছিল, তবু, এরই
সঙ্গে বেহায় বসতে রাজী হয়েছিল সে। সে আজও বুঝতে পারেনা
‘ইয়ার নাম প্রেম কিনা?’
বাপ মরতে
গাঁয়ের লোকের চল্লিশ পঞ্চাশটা ছাগল
চরানির কাজ নিয়ে বড়াশুলির বনে যেত। এই
ছাগল চরানির কাজে যা পেত এবং তার মা বনে শালপাতা টুঁইগে এনে
খালি পাতা সেলাই করে শুকিয়ে বাজারে
বিক্রী করে যা পেত তাই দিয়েই তাদের সংসার চলত। ছাগল
চরানি শক্ত কাজই বলতে হবে । বনে হুঁড়ার, শিয়াল
আছে, আর আছে চোর।
তাছাড়া বদায় যখন পাঁঠিকে ঘুটকায়, তখন তাকে
ঘরে ঘুরাতে জীবন যায়। কিন্তু একাজে তাকে পথথমলে সাহায্য করেছে
লব! সে তখন বড় মাহাতর গরু কাড়া বাগালি করত সকল
গরু, কাড়া, ছাগল বাগালনের
নেতা ছিল সে। কাড়ার পিঠে চড়ে সকলোর গরু-কাড়া- ছাগল
নজরে রাইখত। আর উয়ারা কদমতলায়
বইসে মেয়েলি খেলা খেলত, কি
বনের ছাতু কূড়াত কিংবা বনের ফুল, ফল, কন্দ, মূল যোগাড় করত।
কুড়ুচি ফুলের মালা গাঁথত ঝলকি। কিন্তু লবকে
দেওয়ার সাহস পায়নি। মালা বড়াম ঠাকুরের থানে দিয়ে দিত। দুপহর হল্য যোগাড়
করা ফলমূলে সমবেত ভোজ হত।
সে খুশী মনে তার অংশ তুলে দিত লবর হাতে। সে
কেবল বলত, তুই খাবি নাই ঝলকি? মাথা ঝুঁকাই সে
কেবল বলত, খাও ন, দিলি। এই কথা বলে সে টেরাই ভালত লবর দিকে।
মাঝে মাঝে লব তাকে কাড়ার পিঠে চড়াই ঘুরাত বনের গভীরে। কাড়া
দৌড়ত আঁতাড় লতার ডাল গায়ে লাগলে সাপ মনে করে সে সিঁটাই
উঠত। লব তখন জড়াই ধরে বলত, ডরাস
কেনে, ডরাস কেনে? আঁতাড় ডাল,
ভয়ের কি?
এক বসন্তের
বিকেলে সে যখন কাড়ার পিঠে ঘুরছে তখন পশ্চিম আকাশে সিন্দুর ছিটাই দিয়েছে মনে হল
ঝলকির। সিন্দুরে মেঘ দেখে তার দেহ মন সিরসিরাই
উঠল। পুতরুঙ্গির খালে যেমন লইতন বর্ষার জল ঝরঝরাই
নামে তার রক্তস্রাতের মধ্যে লইতন রক্তস্রোতের
ধারা প্রবাহিত হয়ে বাইর হবার পথ খুঁজতে
লাগল। কাপড় রক্ত ধারায় ভেসে গেল। দৃঢ়, দীপ্ত কন্ঠে সে
বলল, কাড়া দাঁড় করা। আমি এইখিনেই এখন নাইমৰ।
মায়ের কাছে যাব।
এরপর ছাগল বাগালির কাজ ছেড়ে দিয়ে ঘরে
বসেই পাতা সেলাই করতে লাগল। মাঝে মাঝে অকারণ পূলকে
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। করম পূজার দিন নাচের
মধ্যমণি হল সে। আর অজান্তেই একটা গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে ঘরে
ফিরে এল।
“আমি তরই সঁগে বাইরাই
যাব।
সুখে নাই থাকি, দুখ হলেও পাব।
আমি তােরই সঙ্গে বাইরাই যাব।”
মা শুনে বইল্ল- ঢং, মা বিয়াল নাই, বিয়াল মাসি, ঝাল পিপুল খ্যাল
পাড়া পড়সি।
কৈশোরের
সঙ্গী লব-র সঙ্গে
বিবাহ প্রস্তাবে লবর বয়স বেশী বলে মা গররাজী ছিল।
সে বয়সের ব্যাপারে বলল, – পুরুষ মানুষের আবার বয়স কি? মা অবাক হয়ে ছড়া কাটা –
'মা মরে ঝি-এর তরে, ঝি মরে
বুড়া নাঙ-এর তরে। বিয়ে কিন্তুক হল লবর সঙ্গেই। পুকুর
আড়ার দুকুঠুরী ঘর তুলে দিলেন বড় মাহাত। বছর ঘুরতেই ছেলের মা হল। সে। আর বড় মাহত
মইরতেই বাবুর বাড়ীর ভাতুয়ার কাজ ছাড় দিয়ে ছো নাচের
দল বানাল। দল গড়ল ঝুমুর নাচের।
লব ছিল হাউসি। রসিক মানুষ। শিল্পী মানুষ। ছো, পাতা,
ঝুমুর দল নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ফিরত। বাড়ী ফিরেই আবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ত। বাঘ যেমন আঁচড়ে কামড়ে
বাঘিনীকে সোহাগ দেখায়, ভোগ করে,
লবও সেই লেখেন। কিছুতেই তৃপ্তি
নেই, তবু সে লবকে অমান্য করতে পারেনি। লবর আহ্বানে বার
বার শয্যাসঙ্গিনী হয়ে সন্তানের জন্ম দিতে দিতে
ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত। তবুও বলতে পারেনি- লে লে তর
পচলা পিরিত ফিরাঁই লে। বরং
সংসারে হাল ধরতে গিয়ে অকইথ শ্রম করেছে। ফরেষ্ট গার্ডের চোখ এড়িয়ে গাছ কেটে এনেছে। চেলা ফাইলা করে
মাথায় বোঝা নিয়ে লোধাশুলি
মানিকপাড়ায় বিক্রি করে চাল ডাল কিনে এনে ছেলে মেয়েদের মুখে অন্ন জুগিয়েছে। গাঁয়ের
সুরেন মহাপাত্র ফরেষ্ট গার্ড হয়েছে। একদিন বালিভাসা চকে দেখা। বইলল,
শুধুই দুখ পাছিস ঝলকি। বালিভাষার
হটেল আইলে এক রাতে একশ। ঝলকির চইখ ঝলসে
উঠে, বলে- মড়া, মা মাউগা,
খালভরা, নিজের মাউগকে পাঠা ন আগে। সুরেন দাঁত গিজড়াই
পালায়।
গাঁয়ের
ঘরে ঘরে এখন মদ চোলাই করে। তাই দেখে সেও মদ
চোলাই করে গাঁয়ের সঙ্গীসাথীর সঙ্গে খড়গপুর বিক্রি
করতে গেছল। কিন্তু মদের খরিদ্দার মদের সঙ্গে নারীদেহও চায়। ফলে এ
ব্যবসায় সে টিকে থাকতে পারেনি।
ঘরে সাত সাতটা
ক্ষুধার্ত মুখ। ছেলেরা সকাল থেকেই খাই খাই
করে। বাধ্য হয়ে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলে যেতে হয়। এখন দলমা পাহাড় থেকে দলে দলে
হাতি নেমে এসেছে ঝাড়গ্রামের জঙ্গল এলাকায়। তাদের বাসস্থানে নির্মমভাবে জঙ্গল কেটে ফেলা
হচ্ছে। খনিজ সম্পদ
আহরণের জন্য নিত্য পাহাড়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে।
ফলে তারা খাদ্যের অভাবে, বাসস্থানের নিভৃতি ও প্রশান্তির
অভাবে, প্রজনন ও সন্তান পালনের অসুবিধার জন্য ঝাড়গ্রামের
বনে বনান্তরে চলে এসেছে। এই বুনো হাতিদের ভয়
বুকে নিয়েই ঝলকি বনে যায়
কাঠ সংগ্রহে।
পাশের খাটে লব
ঘুমাচ্ছে। কাল নেশা করে ছিল তাই ঘুমটা গভীর। রাত পোহালে ছেলে-মেয়েদের মুখে আহার যোগাতে
হবে। অথচ লব ‘ওরে দলমার
দামাল, তরে কি করে দিই সামাল’ বলে ঝুমুর গান বেঁধেছে। কত রাত
হল কে জানে। ভোর থেকে মহুল কুড়ালে একদিনের অন্নের
সংস্থান দেওয়া যাবে। সে লবকে ঠেলা মেরে বলে -
পুখুর আড়ায় মহুল
গাছ, লকে কুড়াই খাছে।
দেখনা গো বাবুর বাপ রাত
কত আছে ন সকাল পুহাই গেছে।
লব বলে
- বনুয়াহাতি ঘুরছে দলে
দলে ।
কেমন করে যাবি মহুল তলে।
যাতেই
হবে; নইলে খাদ্যের যোগাড় হবে না।
তাই ঝলকি বলে-
হুড়কা খুল্যে ভুড়কা তারা দেখ ন কপাট ফাঁকে,
হাতে লিঞে আউগা তুই আমি আছি পাছে।
লবর
সাহস কুলায় না। সে ছিলনার আশ্রয় নেয়। ঝলকিকে
বলতে পারে না তার অনিচ্ছার কথা। সে সহজ কথাটা সহজ ভাবেই বুঝে – আপনি বাঁচলে বাপের
নাম । তাই বলে –
কুইলি ডাকে আধা রাইতে
ঘুমে কি আর দিশা থাকে।
গাঢ়ায় খালে পইড়ব শেষে।
লবর কথা
যেন গায়ে আগুন ছিটিয়ে দেয়। ভখা পেটে খাবার
জুটাতে হল্যে ভয়কে জয় করতে হবে। তাই সে লবকে
সাহস জুগিয়ে বলে—
‘রাস্তা যদি নাই দেখছে
ধরগো আঁচল খুঁটে
হলুদ বরণ পাইক দুটা চালে চড়ে ডাকে
পাছে সকাল পুহাঞি গেছে।
এই বলে
সে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। খুধা এক রোগ বটে মরণের পথে
হাতছানি দিয়ে ডাকে। বাঁচতে হলে ডরালে চলে। মরার ঝুঁকি লিয়ে বাইরাই
পড়ে— হে হাতি ঠাকুর, দেখবি বাপ, যেমন ঘরে ঘুর্যে
ছানাপুনার হাসি মুখ
দেখি।
No comments