Header Ads


 

কে সেই নারী - ভোলানাথ মাহাত

ছোটগল্প : কে সেই নারী
লিখেছেন: ভোলানাথ মাহাত

আপনি ভুল করছেন, আমি মহুয়া নই।”

এক ফাগুনের ক্লান্ত ভোরে যখন কোকিল অচঞ্চল বেগে তার নিজস্বতা বজায় রেখে চলেছে, তখন চিরন্তন একটা ধারাবাহিক ভাবে ঘটে না যাওয়া স্বপ্ন দেখলশরতের পেঁজা তুলোর মতো রাঙা বৌ-এর স্বপ্ন, কিন্তু বড় অসহায়, বড় বেদনাময় সে দেখল একটা চলন্ত ট্রেনের মধ্যে সে একা বসে অজানা কোন জায়গায় পাড়ি দিচ্ছে, তার কামরার দুয়ারে হঠাৎ করে ফুটফুটে এক নারী, যেন মনে হয় কালের সব যুবকের হাসি লুটে নিয়ে বড় শান্তিতে আছে টকটকে সিন্দুরের রঙটা যেন বলতে চাইছে হে পুরুষ, আমি সেই নারী যে কিনা তপ্ত আঙরাকে চিবিয়ে খাওয়ার মানসিকতা নিয়ে একটি চোখের ইশারাতে সৃষ্টি ধ্বংসের খেলা অনায়াসে খেলতে পারি চিরন্তনের স্বপ্ন দেখার অভ্যাস ছিল, কিন্তু খারাপ স্বপ্ন দেখার অভ্যাস তার ছিল না তাই সে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চেচিয়ে উঠলকিন্তু নারীটি বহুদিনের অভ্যাসের মত চিরন্তনকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল নিজের মানুষের মতো চিরন্তন যেন কাঙ্খিত পৃথিবীর সিংহভাগ মুহূর্তে পেয়েছিলঠিক সেই সময় নারীটি চিরন্তনকে জিজ্ঞাসা করেছিল – “আপনি কি কোনদিন কোন মেয়েকে ভালবেসেছেন?চিরন্তনের মনে হলো সেকি আদৌ স্বপ্ন দেখছে? না একটা বেশ্যা বাস্তব তার মরণ শিয়রে দাঁড়িয়ে কথা বলছে? সে বিমুঢ় হয়ে যায়, ভ্রান্ত সময়ের সব সমস্যাগুলো যেন চিরন্তনের মুখে সদ্য বিবাহিতা বউ-এর চুম্বনের মত ঘিরে বসলসে প্রথমে না বলার চেষ্টা করল, কিন্তু সত্য অপরাজেয় থেকেই চিরন্তনকে পরাজিত করে বলতে বাধ্য করলোশুধু ভালবাসতাম না, পূজা করতাম দেবীর আসনে বসিয়ে কৌতূহলী মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলো- কই আপনার দেবীর একখানি ছবি দেখান, নয়তো তার একটু গল্প শোনান না চিরন্তন গল্প শুরু করল-

আমি তখন এগারো ক্লাসের ছাত্র প্রেমের প্রতি নিজের সামর্থ ও যোগ্যতা না থাকার জন্য একটু খামখেয়ালী থাকতামঅবশ্য ভালও লাগত নাকিন্তু সবারই যখন ভুল হয় তখন ভগবানের ভুল ব্যতিক্রম হয়ে থাকলেও ক্ষতি নেই সংসারে বন্দি এক জন পিতা যেমন তার সর্বস্ব উজাড় করে তার অভাবের সংসারে, ঠিক তেমনিভাবে আমিও একটি নারীর হৃদয়ে আমার নিজের যাবতীয় উজাড় করে দিয়েছিলাম উজাড় করে দেওয়াটা যদি পৃথিবীর অনেক ভুলের মধ্যে একটি ভুল হয়, তবে সেটা হবে আমার অনাকাঙ্খিত পাওনা

          তারপর দেখতে দেখতে তিন- চারটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল রেল গাড়ীর চাকার মতো ঘর্ষণ খাওয়া রূঢ় জীবনে প্রেম নামক শব্দটাভাদ্রের পশু মতো খাঁ খাঁ রৌদ্রে কিছুদিন টহল দিল তারপর হঠাৎ করে একটা পোষ্ট কার্ড পেলাম লিখা আছে ভগবান তোমার মঙ্গল করুক। – তুমি যদি চিঠিটি পাও তাহলে শান্তি পাবঝামেলাবশত তোমাকে আমার বিয়ের দিন জানতে পারিনিতুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও আমরা যেখানে উঠে এসেছি তার ঠিকানা দিলামসময় পেলে এসোইতি- মহুয়া

আমি টের পেলাম বাঁচার মধ্যে মৃত্যুকে অনুভব করা কি আনন্দের। চিঠিখানি ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে ধড়াস করে বসে পড়লাম। তিন বছরের অদর্শনে আমি আদৌও বুঝতে পরিনি নিঃশব্দে বিপ্লব ঘটে যাবে। স্বপ্নে দেখা নারীটি জিজ্ঞাসা করলেন তারপর কি হল? তারপর আমি ঠিকানা বের করে গন্তব্যস্থানে পাড়ি দিলাম। সূর্যাস্তের কিছু আগেই সেখানে পৌছালাম। সেখানে গিয়ে বললাম-এটা কী মহুয়ার বাড়ি? ওর স্বামীর নাম ঠিক মনে নেই। তবে মহুয়া ... সব কিছু বলার আগেই লোকটি বললেন ওঁরা কিছুদিন আগে এবাসা ছেড়ে চলে গেছে, কোথায় গেছেন বলে যান নি।

বড়োই আশ্চর্য লাগল ছন্নছাড়া জীবনযাত্রাকে। নদৰ্মায় স্থান পাওয়া ত্রিশ বছরের পুরানো শারদীয়া সংখ্যা যেমন প্রণাম করে আরেক শারদ সংখ্যাকেঠিক তেমনি ভাবেই প্রণাম করতে ইচ্ছা জেগেছিল মহুয়ার প্রতি আমার।

রাতের অন্ধকারে যখন ষ্টেশনে ট্রেনে দাঁড়াল, তখন রাত্রি খুব একটা হয়নি। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে হঠাৎ করে স্টেশনের সব আলো নিভে গেলহালকা হালকা ষ্টেশনের মানুষগুলো আমার চোখে লাগছিল। হঠাৎ দেখি একটি বৌ তার স্বামীর সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত । তার স্বামী বলছে কেন তুমি কি কোন দিন তোমার ফেলে আসা প্রেমিকের সঙ্গে কদমতলে বসনি? আমাকে কেন মিথ্যে বলছ! সে তো এখানে নেই যে শুনে নিবে তোমার কথা সময়ের অজান্তেই মেয়েটির চোখের জল আমার হাতের তালুয় পড়ল। চোখের জলটা অমার বড় চেনা চেনা মনে হল তার একফোটা চোখের জল আমার কাছে সোনা মানে হল। তখনো পর্যন্তু বউটি কিছু মাত্র উওর করে নি। এমন সময় একটা ট্রেনের আলো সরাসরি মেয়েটির মুখে পড়ল

     এ কি মহুয়া!

আমি অবাক হলাম, কিন্তু তার চেয়েও হতবাক হলাম বেশি। নিজেকে সামলাতে পারলাম না, শুধু চেয়ে রইলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম – মহুয়া! তুমি!

মহুয়া বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বলল- “আপনি ভুল করছেন, আমি মহুয়া নই। আমি…”

কথাটা শেষ করতে না করতেই ট্রেনের ঘণ্টা বেজে গেল। অসংখ্য জনতার ভিড়ে আর একটিবার মহুয়ার ব্যাভিচারিনী মূর্তিটি দেখার শখ ছিল, বড়ো শখ ছিল।

ততক্ষণে স্বপ্নের মেয়েটি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাকে মহুয়ার ছবিটা দেখানো মাত্রই সে বললআপনার সাথে কোনদিন আর মহুয়ার দেখা হয়েছিল কী?

আমি অকপটে ভুল করে বলেছিলাম, প্রতিরাত্রে দেখা হয় ঠিক তোমারই মত স্বপ্নের নারী সেজে।

তারপর অনেক ফাগুনের রাত অনেকের মত কেটে গেছে। অনেক কবিরা মরাডালে ফুল ফুটিয়েছে। শুধু আমি মহুয়ার একটি কথাই মনে রেখেছি – “আপনি ভুল করছেন, আমি মহুয়া নই।”

No comments

Powered by Blogger.