Header Ads


 

বিস্মৃতপ্রায় উপন্যাস : চন্দ্রনাথ বসুর ‘পশুপতি সম্বাদ’ (তৃতীয় পর্ব) - ড.পরিতোষ মাহাত

বিস্মৃতপ্রায় উপন্যাস : চন্দ্রনাথ বসুর ‘পশুপতি সম্বাদ’ (তৃতীয় পর্ব) 
ড.পরিতোষ মাহাত 

[বাংলা উপন্যাসের দেড়শ বছরের আলোচনায় বিদগ্ধ মহলে একবার আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে প্রকাশিত ‘পশুপতি-সম্বাদ’ নামক বিস্মৃতপ্রায় উপন্যাসটির প্রতি আলোকপাতের প্রয়াসেই এই প্রবন্ধের অবতারণা।...আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত দিকভ্রষ্ট বিভ্রান্ত বিমূঢ় নায়ক পশুপতি যেন আধুনিক সুসভ্য নাগরিক জীবনের প্রতিনিধি। যুগের অস্থিরতার আবহাওয়ায় উদগ্র দেশপ্রেমের উন্মত্ততা গ্রাস করার ফলে জীবনের কী পরিণতি হতে পারে ঔপন্যাসিক চন্দ্রনাথ বসু তাঁর এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন। নীতিহীন আদর্শভ্রষ্ট বক্তৃতাবাগীশ পশুপতির চরিত্র উদঘাটন অনবদ্য।...আজকে তৃতীয় পর্ব...]

তৃতীয় ভাগে দেখা যায়, পশুপতির এই দেশপ্রেমিক রূপ যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে তখন খবর এল তার পিতা মৃত্যু শয্যায়। কিন্তু পিতার মৃত্যুশয্যার পাশে গিয়ে না দাঁড়িয়ে বিধবা কুঞ্জকামিনীকে নিয়ে গোপনে অন্যত্র বাসা নেয়।  তার আসল স্বরূপ উদ্ঘাটিত হতে আর সময় লাগল না। প্রাথমিক ভাবে তাকে প্রবৃত্তি পরিচালিত মনে হলেও এটা তার নিজস্ব পতন আর পদস্খলনের জগৎ। তার চারিত্রিক দুর্বলতার শিকার হয়েছে কুঞ্জ। অবশ্য তার ক্লাবের বাকি সদস্যগণ গোপন ডেরার খোঁজ পেয়ে যায় ও তাদের উদ্ধারে ব্রতী হয়। ইঙ্গিতে পণ্ডিত বোঝে। লেখক জানান –
“হতভাগিনী কুঁজি কালামুখী বটে, কিন্তু সেও Pataldanga Debating Club-এর সুশিক্ষিত সুরুচিসম্পন্ন দেশহিতৈষী সভ্য মহাশয়গণের উদ্ধারপ্রণালী দেখিয়া ঘৃণায় আফিঙ খাইয়া প্রাণত্যাগ করিল।” (তৃতীয় ভাগ/১)
তারপর চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সে ফিনফিনে গোঁফ জোড়াটি চেঁচে ফেলে বাড়ি ফেরে। মাকে জানায় যে সে সমস্তই জানত। জেনেই সে গয়ায় গিয়েছিল, পিণ্ডদান করে তবে বাড়িতে এসেছে। তার এই অনৃতভাষণ সত্যরূপে ছড়িয়ে গেল। গ্রামের সমস্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও প্রাচীনেরা ধন্য ধন্য করতে লাগল।
গোধনপুরে প্রত্যাবর্তন করে পশুপতি দেশোদ্ধারের কাজে নেমে পড়ল। গ্রামেই বালিকা বিদ্যালয় ও নারীশিক্ষার নাইট স্কুল খুললকলকাতা থেকে এজন্য দুজন শিক্ষিকা আনা হল। তাদের বেতন দেওয়ার জন্য নিজেদের সম্বল সম্পত্তিতে হাত পড়তে থাকল।
চতুর্থ ভাগে দেশপ্রেমিকদের কর্মধারা অগ্রসর হয়ে পাবলিক লাইব্রেরী, সোশ্যাল ইমপ্রুভমেন্ট সোসাইটি গঠিত হল। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে বাদানুবাদে পশুপতি নিজেই উপন্যাস ও কবিতার বই লিখতে নামলেন। মা, স্ত্রী কিংবা নিজের ছয় মাসের শিশুকন্যার দিকে তাকাবার অবসর তার নেই। রোগে ভুগে কন্যা মারা গেল। নিজের সম্পত্তির এই বিনাশী আয়োজনে পরিবারের আপত্তিতে তার ভ্রূক্ষেপ হয় না। বই ছাপাতে গিয়ে চরম অর্থকষ্টের মধ্যে পড়ে সে। বকেয়া আদায়ের জন্য ছাপাখানার মালিক আদালতে গেল। আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে অসমর্থ পশুপতি মামলায় হেরে যায়। কারাবাস হয় তার। জেল হওয়ার খবরে অসুস্থ স্ত্রী রত্নমঞ্জরীর মৃত্যু হয়। পরে গোপবালিকা সাবিত্রী কিছু গহনা বেচে অর্থ সংগ্রহ করে জেল থেকে পশুপতিকে খালাস করে। খালাস পেয়ে পশুপতি গ্রামে ফেরে না। সে সাবিত্রীকে সঙ্গে নিয়ে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে চলে যায়।
কাহিনী বিন্যাসে দেখা যায় পশুপতি চরিত্রে সম্ভাবনা ছিল। সে বুদ্ধিমান, সাহসী এবং আবেগদৃপ্ত। কিন্তু অপরিণামদর্শীতা ও আবেগসর্বস্বতার কারণে তার সমগ্র কর্মকান্ড ও জীবন বিফলে গেছে। যথেষ্ট শিক্ষা থাকলেও যুক্তিবোধ ও বাস্তবজ্ঞানের অপরিমিতত্বের কারণে সে বিভ্রান্ত হয়ে পথ খুঁজেছে। কিন্তু অন্ধ কানাগলির বাঁকে সে বার বার পর্যুদস্ত হয়েছে। চরিত্রের দুর্বলতার জায়গাগুলিতে লেখক নির্দ্বিধায় আলোকপাত করেছেন। নায়কোচিত চারিত্রিক গুণ বা মহত্ত্বের সাধনা তার থাকলেও যুগের সংকটকে সে অস্বীকার করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় চরিত্রের এই রূপ নির্মাণ, দোষে-গুণে ভরা রক্তে-মাংসের জীবন্ত বিগ্রহ সে কালের প্রেক্ষিতে খুব একটা অস্বাভাবিক হয়নি। চরিত্রের পদস্খলন হিসেবে যা দেখানো হয়েছে সেখান থেকে বঙ্কিমের ‘বিষবৃক্ষ’ বা ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র কথা মনে করায়। কুঞ্জকামিনীর প্রসঙ্গ থেকে আখ্যান অন্য মোড় নিতে পারত। আসলে নীতিবাগীশ হিন্দুত্ববাদী লেখক অকালে সে সম্ভাবনার বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছেন। ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও বয়সে বড় গোপবালিকা সাবিত্রীর প্রতি দুর্বলতা এবং শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে দেশত্যাগ দেখানো হলেও সেখানে লেখকের ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গীই প্রতিফলিত। কেননা সেই সম্পর্কের সম্ভাবনার সূত্রপাত ও ইঙ্গিত উপন্যাসের প্রথম ভাগের তৃতীয় পরিচ্ছেদেই দেখা গিয়েছিল। নরনারীর অবৈধ অসামাজিক সম্পর্কের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি লেখকের ছিল বলে মনে হয় না। অথচ ঔপন্যাসিক সম্ভাবনা সেখানে ছিল।
সাধারণ মানুষকে অতিমানবিক রূপ-গুণে ভূষিত করার বাসনা তার ছিল না। এদিক থেকে তিনি যথার্থ বাস্তববাদী লেখকের স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। পশুপতি, প্রমদাচরণ, সাবিত্রী, রত্নমঞ্জরী বাস্তব জীবনরসে ঋদ্ধ হয়ে উঠেছে। যদিও সমস্ত চরিত্রের যথাযথ স্ফূরণে লেখকের বিশেষ প্রযত্ন দেখা যায় না। (ক্রমশঃ ...)



No comments

Powered by Blogger.