Header Ads


 

ছেলেবেলা : (পর্ব-৩) - বন্দিতা রায়

 

 ছেলেবেলা : ৩
বন্দিতা রায়


গ্রামীণ পরিবেশ যতই খোলামেলা, তটটাই বোধহয় লুকোচুরি। সেকালে আমার পরিচিত পাড়াগুলির বেশিরভাগই চিহ্নিত ছিল জাতের বসতি হিসাবে। স্কুলে পড়ার ফলে সব পাড়াতেই কিছু বন্ধু জুটল। এবং তখনই সমস্যা শুরু হল। সাঁওতাল পাড়ার ছেলেরা খেলে, মেয়েরা প্রায় খেলতই না। পাতর পাড়ার মেয়েরা কড়ি, গুটি, বাঘ-ছাগল খেলত। আর খুব বেশি শিল্প চর্চা করলে মাথার খোঁপার জাল কিংবা গেঞ্জি বানাত। অবশ্য প্রায় সব ছোট মেয়েই চটের আসন বানাত। এই জায়গাগুলোতে আমার স্থান হল না, আমি অযোগ্য বলে।

প্রথম দিকে ভাষা নিয়ে কিছু অসুবিধা হল। সব কথা বুঝতে পারি না। কিন্তু সেটা বাংলাই বটে। যেমন ‘মাটির নিচে খইন আছে।’ ‘আমাদের পায়ের নিচে খুর আছে তাই হাঁটলেই রাস্তার ঘাসগুলা চলি যায়।’ ‘ওরা এবার ভিনু হল।’ আর যা বললে নয় – যেটা আমি শিখলাম – নানান গালিগালাজ। যেমন – বেধামড়া, খালভরা, মা-মাউ…, বাপভাতা…, বারভাতা… ইত্যাদি। ভাষাটা নিজের মনে রপ্ত করে মাকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি কেঁদে ফেললেন। দাদুকে বললেন, এরপর আর কী শিখবে বাবা, এগুলো আর মানুষ হবে না! মায়ের বিলাপ সত্যি হয়েছে।

আর ছিল পরব পার্বণ। আমাদের বাড়িতে উনুনে মনসা পুজো হতো, শালুক ফুল দিয়ে, সেদিন অরন্ধন। ধান কাটা শেষ হলে ধান গছের লক্ষ্মী বকুল গাছ হতে বাড়ির খামারে আসতেন। জলের ঝারা ও শাঁখ বাজিয়ে আনা হতো। খামারের অনেকটা জায়গা জুড়ে মা চাল গুঁড়ি দিয়ে অনেক কিছু আঁকতেন। আমি সব ভুলে গেছি। তাতে বোধহয় মায়েরও কিছু অবদান আছে। সেগুলি ভালো বোঝা যেত না। পুরোহিত দাদু পুজো করলে প্রসাদ পেতাম। তাঁর খুব খাতির যত্ন ছিল। মা বলতেন উনি খুব ভালো মানুষ। ধান ঝাড়া মাড়া শেষ হলে বা না হলেও পয়লা মাঘ লক্ষ্মীর পুজো আবার হতো। সেদিন কিন্তু গাছের আর বনের ‘তারা’ না ডাকলে পুজোর জায়গা থেকে ওঠা চলত না। সেদিন নাকি তারা ডাকে না, প্রথম ডাকলে নাকি মরে যায়। তারা হল শিয়াল এবং পেঁচা।

ভাইফোঁটার আগে গরু চান করিয়ে আলতা, কলমের কালি আর সিম পাতার রস দিয়ে তাদের গায়ে ছাপ দেওয়া হতো। সব ছাপই গোল গোল। মাথার শিং-এ এবং পায়ের খুঁড়ে জল, তেল দেওয়া হতো। ধান শিষের মুকুট তৈরি করে কপালে পরানো হতো। বলদের গলায় বনফুলের মালা পরানো হতো, নতুন কুলোতে করে পিঠে খাওয়ানো হতো। সব মনে নেই। তবে রাতে গরু জাগাতে আসত। সম্ভবত পরের দিন গরু খোঁটানো হতো। আমাদের দাদু গরু খোঁটাতে দিতেন না। গাই গরুদের সঙ্গে আমাদের বেশ ভাব ছিল। তাদের বেশ নামও ছিল। এছাড়া ছিল ভুয়াং নাচ, কাঠি নাচ, রুমাল নাচ। এই সব নাচের মৃদুতা, সঙ্গত ও সারল্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

সাঁওতাল পাড়ার ছেলেরা শিকারে বেরোতো। তার আগে গুলতি এবং তীর ধনুকে হাত পাকাত। পুকুরের ব্যাঙ এবং গাছের পাখি শিকার করে। শিকারের সঙ্গী ছিল দেশী কুকুর। তারা খুব পটু ছিল। তাদের আমি ভয় পেতাম।

এছাড়া ছিল ‘ভেজাবিঁধা’ যাকে বলে লক্ষ্যভেদ। একটা কলা গাছের গুঁড়িকে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট দুরত্ব থেকে বিঁধতে পারলে ভেড়া আর কাপড় পাওয়া যেত। (চলবে…)

No comments

Powered by Blogger.