Header Ads


 

জঙ্গলমহলের চিত্রকলা - ড. পরিতোষ মাহাত

জঙ্গলমহলের চিত্রকলা 
ড. পরিতোষ মাহাত 


        আদিবাসী (জনজাতি) অধ্যুষিত অরণ্যপর্বতসংকুল ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চলের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, সিংভূম, ময়ূরভঞ্জ প্রভৃতি জেলা জঙ্গলমহল নামে সুপরিচিত। এই অঞ্চলে আদিবাসী জনজাতিই আদিম জনজাতি। এই আদিম জনজাতির আবাসভূমি পুরাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বিশ্বের প্রাচীনতম ভূমিরূপ হিসেবে সুচিহ্নিত হয়েছে। প্রাচীন গ্রাম নাম, নদীর নাম, উদ্ভিদ, ফসল, দেবদেবী এবং এখানকার ভাষা-উপভাষার অজস্র দেশি শব্দ (অষ্ট্রিক – দ্রাবিড়) সেই আদিম জন-মানুষের প্রভাব ও প্রাধান্যকে সূচিত করে। প্রাগৈতিহাসিক পুরাতত্ত্বের এক মূল্যবান খনি ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চল বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। পুরাতাত্ত্বিক আলোচনার ধারা নিয়ন্ত্রিত হয় আঞ্চলিক পর্যায়ের ক্ষেত্রানুসন্ধান ও খনন কার্যের দ্বারা। ইতিহাসের কোন পর্বে অথবা প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোন স্তরে এই অঞ্চলে মানুষ প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল তার সঠিক বিবরণ আমাদের জানা নেই। তবে এই অঞ্চলের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ ড. বিনয় মাহাত বলেছেন – “এই অঞ্চলের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। ঝাড়গ্রাম, ধলভূম, মানভূম অঞ্চলের গভীর অরণ্যে আজও ছড়িয়ে আছে প্রাক-আর্য সভ্যতার বহু নিদর্শন। সুবর্ণরেখার তীরে দুলমী গ্রামে প্রাচীন এক সভ্যতার নিদর্শন আজও বর্তমান। ঝাড়গ্রাম মহকুমার কুলটিকরী গ্রামে টিপকিয়ার চাঁদের অগণিত প্রস্তর স্তম্ভ, পিতলকাঁঠি গ্রামের জয়চণ্ডীর মন্দির, শুকনিবাসা গ্রামের গুপ্তমণির থান আজও বহন করে চলেছে আর্যেতর সভ্যতার এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর। বাঁকুড়া জেলার বন আসুরিয়া গ্রামে পাওয়া গেছে প্রস্তর যুগের কুঠার এবং ফলক। অনুরূপ কুঠার এবং ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে ধলভূম এবং মানভূমেও। ঝাড়গ্রামের নিকটবর্তী লালগড়ে পাওয়া গেছে নব্য প্রস্তর যুগের অস্ত্রশস্ত্র। তাম্রনির্মিত অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে বিনপুর থানার তামাজুড়ি গ্রামে। ... মানভূম এবং মল্লভূমের অর্থাৎ বর্তমান ঝাড়গ্রাম এবং পুরুলিয়ার সীমান্তে এক গহন অরণ্য অঞ্চলে এই গ্রামের অবস্থান। এখনো এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের যথেষ্ট অবকাশ আছে বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করে থাকেন।”[ ১] 
        ছোটনাগপুরের মালভূমিই মুখ্যত পশ্চিমের ক্ষয়প্রাপ্ত মালভূমি ও তরঙ্গায়িত উচ্চভূমি। অবস্থান - বিস্তৃতি ও সীমানা পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তের সমগ্র পুরুলিয়া জেলা সহ বর্ধমান, মেদিনীপুর, বীরভূম ও বাঁকুড়া জেলার পশ্চিমদিকের অংশ। এই সমুদয় অঞ্চলটি ছোটনাগপুরের মালভূমিরই একটি অংশ। পশ্চিমে ক্ষয়প্রাপ্ত মালভূমির পূর্বদিকে রাঢ় অঞ্চল, পশ্চিমে ঝাড়খণ্ড, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়িষ্যা এবং উত্তর দিকে বিহার রাজ্য। অঞ্চলটির ভূ-প্রকৃতির আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য হল ঢেউ খেলানো ও অসমতল ভূমি। প্রাচীন গ্রানাইট ও নাইস শিলাকে বক্ষে ধারণ করে হাজার হাজার বছরের অতীতের স্মৃতি নিয়ে এই বিস্তীর্ণ ভূমিভাগ জেগে আছে। মাঝে মাঝে টাইড়, টিলা, টিকর, বুরু, ঘুটু, ডাহি, ডুংরি, ডহর, জোড়, খাল, ঢঢ়া, গাঢ়া, নদী, নালা, কানালি, বাইদ, শোল, বহাল প্রভৃতি বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপ দিয়ে এই অঞ্চল সু-সজ্জিত। আঞ্চলিক ভূ-ভাগ শুষ্কপ্রায়, শীর্ণ জলধারায় জারিত। 
        ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এই অঞ্চলের জনজাতি ও সংস্কৃতি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এই অঞ্চলের পরিচয় দিতে গিয়ে ড. বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত জানিয়েছেন যে, ‘ভারতের এই আদিম ভূমিখণ্ডে সেই গাণ্ডোয়ানা থেকে খড়্গপুর পর্যন্ত আদিম অধিবাসীদের বাসভূমি প্রসারিত, যাদের মধ্যে রয়েছে দ্রাবিড়, আদি-অষ্ট্রেলীয় গোষ্ঠীর লোকেরা।’[ ২] ড. নমিতা মণ্ডল বলেছেন যে, বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত অর্থাৎ বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব ভাগ থেকে মধ্যপ্রদেশের পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত এবং উড়িষ্যার উত্তরভাগ পর্যন্ত অস্ট্রিক ভাষাঞ্চল। আর্য অভিযানের পূর্ব থেকেই এই অঞ্চলভূমিতে অনার্য মানুষের এক সংহত উপনিবেশ স্থাপিত হয়ে আছে।[ ৩] এই অঞ্চল আদিবাসী প্রধান। প্রটো-অস্ট্রোলয়েড ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর বহু সম্প্রদায় সুপ্রাচীন এই জনপদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ধারক ও বাহক। এদের মধ্যে আছে সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভুমিজ, কুড়মি-মাহাতো, খেড়িয়া, শবর, সরাক, ওঁরাও, বীরহড় কোল, হো, কোড়া, মাহলি প্রভৃতি সম্প্রদায়। সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এই সব গোষ্ঠীর মানুষদের সবিশেষ অবদান রয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে চুয়াড় বিদ্রোহ বা পাইক বিদ্রোহের (১৭৭৩ পরবর্তী সময়ে) কথা। এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী ঝাড়গ্রাম, ফুলকুশমা, ঘাটশিলা, বগড়ী, বিষ্ণুপুর, সিংভূম, ময়ূরভঞ্জ, ধারিন্দা, কর্ণগড় প্রভৃতি জায়গার জমিদারদের পাইক ও বরকন্দাজেরা ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নানা উপজাতির লোক। যথা, ভঞ্জ, কোড়া, মুণ্ডা, কুড়মি, বাগদি, মাঝি, লোধা ইত্যাদি।[৪ ] একসময় জঙ্গল নির্ভর ছিল এই সব গোষ্ঠীর মানুষজন। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এরা জঙ্গল থেকে কাঠ, পাতা, মধু, মোম, লাক্ষা, তসর বা রেশম, নানান পাখিদের পালক যেমন ময়ূর ও নীলকন্ঠ পাখির পালক, হরিণ ও মোষের শিং সংগ্রহ করতো। হান্টার সাহেব জানিয়েছেন,- “The castes which subsist by collecting and trading in jungle products are the Manjhis, Bhumijs, Santals, Kurmis and Lodhas.”[ ৫] 
    যাইহোক, সমাজতাত্ত্বিক-পুরাতাত্ত্বিক-নৃতাত্ত্বিক পণ্ডিতদের মতে, সমগ্র পশ্চিম প্রান্ত-বঙ্গের অনার্য জাতিগোষ্ঠীর সর্বপ্রধান প্রতিপত্তিশালী বাসিন্দা হল সাঁওতাল। জঙ্গলমহলের সাংস্কৃতিক চালচিত্র পর্যবেক্ষণ করলে প্রতীয়মান হয়, অস্ট্রিকভাষী সভ্যতা ও সংস্কৃতির বনিয়াদ নির্মাণের ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে প্রধানত সাঁওতাল, মুণ্ডা এবং কুর্মী সম্প্রদায়।[৬] ড. অনিমেষকান্তি পাল বলেছেন,- “সীমান্ত বাংলার কুর্মী সম্প্রদায় কেবল সংখ্যার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নন, তারা বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিরও অতি গুরুত্বপূর্ণ ধারক ও বাহক।"”[৭] জঙ্গলমহলের সাংস্কৃতিক জগতে বিশেষত লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্যের ধারায় এদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা গবেষক-পণ্ডিতগণ স্বীকার করে থাকেন। এই সমস্ত শ্রেণীর মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হিসেবে আমরা লোকশিল্পের অন্যতম প্রধান দিক লোকচিত্রকলা বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করবো। (ক্রমশ ...)
বাঁদনা পরবের আলপনা চিত্র ও মুখোশ [৮]


তথ্যসূত্র

[১]. মাহাত, বিনয়। ‘লোকায়ত ঝাড়খণ্ড’। নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা – ৯। প্রথম প্রকাশ - সেপ্টেম্বর ১৯৮৪। পৃ- ৩-৪

[২]. মাহাত, বঙ্কিম। ‘ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য’। বাণীশিল্প, কলকাতা – ৯। প্রথম বাণীশিল্প সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০০ (প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ১৯৭৮)। পৃ-১৩

[৩]. মণ্ডল, নমিতা। ‘বাঁকুড়াকেন্দ্রিক মল্লভূমের উপভাষা’। বাঁকুড়া লোকসংস্কৃতি অকাদেমি, বাঁকুড়া। দ্বিতীয় মুদ্রণ মে ১৯৬৪। পৃ-৩০।

[৪]. ভট্টাচার্য, তরুণদেব। ‘পশ্চিমবঙ্গ দর্শনঃ মেদিনীপুর’। ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা – ১২। প্রথম প্রকাশ – ১৯৭৯। পৃ – ২৮

[৫].  Hunter, W. W.: ‘A Statistical Account of Bengal’, Districts of Midnapur and Hugli (including Howrah), Vol. – III.  Turbner & Co., London. 1876. P.-39.

[৬]. দে, মধুপ। ‘ঝাড়গ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি’। মনফকিরা, কলকাতা – ৯৩। প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ২০১৩। (ISBN: 978-93-80542-52-2).  পৃ - ২৩

[৭]. পাল, অনিমেষকান্তি। ‘মেদিনীপুরঃ জনসম্প্রদায় ও লোকসংস্কৃতি’। দ্রঃ কর্মকার, লক্ষ্মণ সম্পাদিত ‘সৃজন’। মেদিনীপুরের লোকসংস্কৃতি বিশেষ  সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০০৯-মার্চ ২০১০। ঘাটাল, পশ্চিম মেদিনীপুর। পৃ–২ 

(৮) চিত্রসুত্র - ফেসবুক (পল্লব মণ্ডল) 

No comments

Powered by Blogger.