গ্রন্থ পর্যালোচনা : কারাম - পর্যালোচনা করেছেন - ড. পরিতোষ মাহাত
গ্রন্থ পর্যালোচনা : কারাম
(সাদরি ভাষা শিক্ষার পুস্তক)
পর্যালোচনা করেছেন ড. পরিতোষ মাহাত
লোকসংস্কৃতিবিদ সুহৃদকুমার ভৌমিকের মতে, পূর্ব মগধীজাত ভাষাগুলির
মধ্যে সাদরি সর্বাধিক অনাদৃত, অবহেলিত অথচ শক্তিশালী এক ভাষা। এটি হল ছোটনাগপুরের মাটির
ভাষা। শব্দটি এসেছে ‘সদর’ শব্দ থেকে। রাঁচি সদরের ভাষাই আজকের সাদরি ভাষা। সাদরি ভাষার
সঙ্গে ভোজপুরি তো বটেই, বাঙলা, মাগহি এবং ওড়িয়ার সাদৃশ্য লক্ষনীয়। স্যার গ্রিয়ার্সন
যখন Linguistic Survey এর কাজ শুরু করেন, তখন তিনি সাদরি নাম দিয়ে একাধিক উপভাষার সন্ধান
পান। বোঝাই যায় বিভিন্ন অঞ্চলের সদর শহরগুলিতে এই জাতীয় বহু ভাষা প্রচলিত ছিল। গ্রিয়ার্সনের
মূল বক্তব্য হল যখন কোন আদিবাসী অন-আদিবাসীর সঙ্গে ভাব বিনিময়ের জন্য ইন্দোয়ুরোপীয়
ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হন তখনই একটি নতুন ভাষার জন্ম হয় যা সাদরি নামে পরিচিত। গ্রিয়ার্সনের
সময় এই ভাষায় সাহিত্য সম্ভার কিছুই ছিল না। সাদরি ভাষার প্রথম সার্থক ও শুদ্ধ ব্যাকরণ
রচনা করেন রেভাঃ নাওরঙ্গী। ‘সাদরি পাড়হা’ গ্রন্থের রচয়িতা কালিপদ সরদার বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের
৩৮টি আদিবাসী গোষ্ঠী আছে তার মধ্যে সাঁওতাল গোষ্ঠী ছাড়া ৩৭টি আদিবাসী গোষ্ঠীর অধিকাংশই
গোষ্ঠীই, ওঁরাও, মুণ্ডা, ভূমিজ, শবর, বেদিয়া, কোড়া ইত্যাদি আদিবাসীদের মাতৃভাষা হচ্ছে
সাদরি। … সাদরি ভাষা পশ্চিমবঙ্গের নয়, বিহার, ওড়িষ্যা, আসাম ও ত্রিপুরার আদিবাসীদের
কথ্য ভাষা (Spoken Language) বাড়িতে ইহারা মাতৃভাষায় কথা বলেন।” সাদরি ভাষা যে বাংলাদেশেও
সুপ্রচলিত তা ঠিক কোন কারণে তিনি উল্লেখ করলেন না, তা সুস্পষ্ট নয়। যাইহোক, সাম্প্রতিককালে
নানা কথ্য ভাষার প্রচার, প্রসার ও শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে নানা দেশে ভাষাবিদদের প্রচেষ্টা
ও সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এমনই
এক উদ্যোগ নিয়ে সাদরি ভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছেন। বইটির নাম ‘কারাম’।
‘কারাম’ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ কর্তৃক
প্রকাশিত ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ সাদরি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রণীত একটি পুস্তক।
মূলত সাদরি ভাষা চর্চা ও ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ছোটদের জন্যে ১৪ পৃষ্ঠার
এই বইটিতে ধারমা আর কারমা এই দুই ভাইয়ের প্রচলিত গল্পটি অত্যন্ত সুচারু ও সংক্ষিপ্তভাবে
উপস্থাপন করা হয়েছে। সাদরি ভাষার একটু দৃষ্টান্ত বইটি থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। যেমন
–
“ধারমা আর কারমা দুয়ো ভাই। কারমা খেতনে কাম কারেলা আর ধারমা পূজা
কারেলা। একদিন কারমা কাম কারে যায় রেহে পাথারনে। আর ধারমা কারাম পূজা লেইকে ব্যস্ত
রেহে। কারমা পাথারসে আয়কে ধারমাকের কারাম পূজা কারেক দেখকে খিসাই গেলেই। কারমা খিসাইকে
কাহাথে হাম কাম কারাথি আর তঁয় ঘারনে বেইস বেইসকে পূজা কারাথিন। ই কেইকে, পূজা আখড়ানে
ঢুইককে কারাম গাছকে উঠায়কে নাদীনে ফেইক দেলেই।”
ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত ছোটরা অনায়াস দক্ষতায় নানা
ভাষা আয়ত্ত করতে সক্ষম। তাই ভাষা শিক্ষার জন্যে এই বয়সী পড়ুয়াদের পাঠ্যক্রমে বিশেষ
যত্নবান হওয়া দরকার। সুতরাং বাংলাদেশ সরকারের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সাধুবাদের যোগ্য।বইটির
উন্নয়ন ও অভিযোজনে বিশিষ্ট যোগেন্দ্র নাথ সরকার (টপ্প), সহকারী অধ্যাপক, নিমগাছি কলেজ,
রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ; কল্যাণী মিনজি, প্রধান শিক্ষক, সোনাদিঘী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
গোদাগাড়ি, রাজশাহী; অজিত কুমার সরদার (তির্কি), সহকারী সিনিয়র শিক্ষক, ভাদসা উচ্চ বিদ্যালয়,
জয়পুরহাট; নির্মল কুমার মাহাতো, সহকারী প্রধান শিক্ষক, খৈচালা আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়,
রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ; রণজিৎ কুমার মালো, সহকারী প্রধান শিক্ষক, চাইল্ড হোম, জয়পুরহাট;
বঙ্গপাল সরদার, সমন্বয়কারী, লাহান্তি ফাউন্ডেশন, রাজশাহী। সার্বিক নির্দেশনায় প্রফেসর
নারায়ণ চন্দ্র সাহা, চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ। বইটির প্রাসঙ্গিক ও আকর্ষণীয় চিত্রগুলি অঙ্কন করেছেন
লুম্বিনী দেওয়ান।প্রচ্ছদ এঁকেছেন কনক চাঁপা চাকমা। প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০১৬।
(বইটি পড়তে চাইলে আগ্রহীরা কমেন্ট করে জানাবেন।)
শুভেচ্ছা নিবেন।
ReplyDeleteকারাম বইটি পেতে চাই- বইটি পেতে সাহায্য করুন।