Header Ads


 

বিস্মৃতপ্রায় উপন্যাস : চন্দ্রনাথ বসুর ‘পশুপতি সম্বাদ’ (দ্বিতীয় পর্ব) - ড.পরিতোষ মাহাত

 [বাংলা উপন্যাসের দেড়শ বছরের আলোচনায় বিদগ্ধ মহলে একবার আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে প্রকাশিত ‘পশুপতি-সম্বাদ’ নামক বিস্মৃতপ্রায় উপন্যাসটির প্রতি আলোকপাতের প্রয়াসেই এই প্রবন্ধের অবতারণা।...আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত দিকভ্রষ্ট বিভ্রান্ত বিমূঢ় নায়ক পশুপতি যেন আধুনিক সুসভ্য নাগরিক জীবনের প্রতিনিধি। যুগের অস্থিরতার আবহাওয়ায় উদগ্র দেশপ্রেমের উন্মত্ততা গ্রাস করার ফলে জীবনের কী পরিণতি হতে পারে ঔপন্যাসিক চন্দ্রনাথ বসু তাঁর এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন। নীতিহীন আদর্শভ্রষ্ট বক্তৃতাবাগীশ পশুপতির চরিত্র উদঘাটন অনবদ্য।...দ্বিতীয় পর্ব...]

    ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় চন্দ্রনাথ বসুর ‘পশুপতি সম্বাদ’। মোট চারটি ভাগে উপন্যাসটি রচিত। প্রথম ও চতুর্থ ভাগে ৫টি করে পরিচ্ছেদ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগে ৪টি করেমোট ১৮টি পরিচ্ছেদ। চন্দ্রনাথ বসুর এটি একটি ব্যঙ্গমূলক উপন্যাস। ব্যঙ্গ রসিকতার পরিচয় আমরা তাই শুরু থেকেই পেতে থাকি। কলকাতার অনতিদূরে অবস্থিত গোধনপুর গ্রাম। অধিকাংশ অধিবাসী কৃষিজীবী এবং গোয়ালা। এছাড়া কিছু ব্রাহ্মণ কায়স্থ আছে। ১ম পরিচ্ছেদে এদের প্রসঙ্গ এসেছে। -
“কৃষিজীবীরা চাষ করে, ধান বেচিয়া জমিদারের খাজনা দেয়, খাজনা দিয়া যাহা থাকে, তাহাতে কোনরকমে দিনপাত করে, বড় একটা হাহাকার করে না। কলিকাতার কল্যাণে গোয়ালাদের আজকাল জোর পড়তা। গোধনপুরের গোয়ালারা কলিকাতার বাবুমহলে জলকে দুধ বলিয়া বিক্রয় করিয়া বেশ দশ টাকা লাভ করে, বাবুদের ছেলে মেয়েদের কফ কাশি সারে না, কিন্তু গোয়ালাদের গৃহিণীরা ভাল ভাল সোণার গহনা পরিয়া দশমহাবিদ্যার ন্যায় দশ দিকে দশ রকম মূর্তি প্রকাশ করিয়া গোকুল গোধনপুরের মধ্যে কিছুমাত্র প্রভেদ দেখিতে দেয় না।” (প্রথম ভাগ/ ১)
 এ তো গেল সমাজের একশ্রেণির কথা। যারা তথাকথিত উচ্চবর্ণ তাদের পরিচয়ও লেখক দিয়েছেন। তারা কেউ তেমন ধনশালী নয়। অল্প কিছু কিছু চাষ আছে, চাষের ধানেই তাদের প্রধান অবলম্বন।
“কিন্তু আজকাল গোধনপুরের ব্রাহ্মণকায়স্থদিগের আর পূর্ব্বের মত সুখ শান্তি নাই। গ্রামের গোয়ালিনীদের গায় সোণাদানা দেখিয়া তাঁহাদের আর খাইয়া পরিয়া সুখ হয় না।” (ঐ)
এই গোধনপুরেই উমাপতি ভট্টাচার্যের বাস। স্ত্রীর নাম দুর্গামণি দেবী। এই দম্পতির সন্তান পশুপতি। ১ম ভাগের ৩য় পরিচ্ছেদে পশুপতির বাল্যশিক্ষা প্রসঙ্গ এসেছে। লেখক জানাচ্ছেন –
“পশুপতির পড়াশুনায় অত্যন্ত মনোযোগ। সে প্রত্যহ লিখিবার তালপাতা ছিঁড়িয়া ফেলে; ফেলিয়া, লিখিবার সময় না লিখিয়া তালগাছে তালগাছে তালপাতা কাটিয়া বেড়ায়।” (প্রথম ভাগ/ ৩)
 ইংরাজী শিক্ষার জন্য পরে তাকে কলকাতার পটলডাঙ্গায় কাঙ্গালিচরণ চক্রবর্তীর আশ্রয়ে রেখে লেখাপড়া শেখাবার ভার অর্পণ করেন।
        
        দ্বিতীয় ভাগে আমরা পশুপতির শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে পারি। আট বছর সারস্বত সাধনার ফলে সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় ছাত্রবৃত্তিসহ উত্তীর্ণ হল, তখন কাঙ্গালিবাবুর পরামর্শে পরম রূপবতী ও গুণবতী এক কন্যার সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন।
“এদিকে শ্রীমান পশুপতি ভাট্টাচার্য্য দেখিলেন যে, তাঁহার বিবাহ হইয়াছে এবং তিনি একটা ‘পাস’ও করিয়াছেন। অতএব তিনি এখন একটা মানুষ – একটা দিগগজ পণ্ডিত বলিলেই হয়। অতএব আর পড়াশুনা করা অনাবশ্যক,” (দ্বিতীয় ভাগ/২)
 উচ্চশিক্ষার দিকে না এগিয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ল সে। মাথায় চেপে বসে পরোপকারের ব্রত, আত্মত্যাগের সঙ্কল্প। দেশোদ্ধারের প্রথম হাতে খড়ি শুরু কাঙ্গালিচরণের বাড়ি থেকেই হল।–
“কাঙ্গালি বাবুর হিতার্থ তাঁহার অষ্টাদশ-বর্ষীয়া বিধবা কন্যা শ্রীভ্রষ্টা (কেন না পতিহীনা) কুঞ্জকামিনী দেবীকে অধিক রাত্রে গোপনে লেখাপড়া শিখাইতে আরম্ভ করিয়াছেন।” (দ্বিতীয় ভাগ/২)
নারীশিক্ষার বিশেষত বিধবা নারীর শিক্ষার এই প্রযত্ন দেখে আমরা পশুপতির মহত্ত্ব সম্পর্কে সচেতন হই। শুধু তার প্রবৃত্তি কতটা মহৎ সে নিয়ে কৌতূহল জাগে। এরপর পটলডাঙ্গা ডিবেটিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা। -
“সেখানে প্রতি সপ্তাহে ধর্ম্মবিষয়ক, নীতিবিষয়ক, ইংরাজ রাজার দৌরাত্ম্য বিষয়ক, এবং আরো অনেক বিষয় বিষয়ক প্রবন্ধ পঠিত হইতে লাগিল, এবং প্রবন্ধ পাঠ হইলে পর ভূমিতে পদাঘাত, টেবিলে মুষ্ট্যাঘাত এবং কপালে করাঘাত সহকারে মহা তর্ক বিতর্ক হইতে লাগিল।” (দ্বিতীয় ভাগ/২)
দেশোদ্ধারের সংকল্পে এই যে আলোচনাসভা, ক্লাব নির্মাণ তার ট্র্যাডিশন আমরা তো আজকের দিনেও বয়ে নিয়ে চলেছিতাই কিনা এত সভা এবং বক্তৃতার আয়োজন, আমাদের আস্ফালন। সে যাই হোক পটলডাঙ্গার এই ক্লাবের সভ্যগণের স্থির সিদ্ধান্ত হল –
“ধর্ম্মের উদ্ধার, নীতির উদ্ধার, জাতির উদ্ধার, দেশের উদ্ধার, বালবধূর উদ্ধার, বালবিধবার উদ্ধার, সমস্ত ভারতমহিলার উদ্ধার, বিদ্যার উদ্ধার, অবিদ্যার উদ্ধার, উদ্ধার, উদ্ধার, উদ্ধার।” (দ্বিতীয় ভাগ/৩)
শুধু এই নয়, তাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ল বাংলা সাহিত্য বিচার ও পর্যালোচনার দিকেও। নিদারুন অভিঘাত বঙ্কিমচন্দ্রের ওপর পড়ল। প্রবল সমালোচিত হলেন হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, কালীপ্রসন্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়চন্দ্র সরকার। এমনকি নবীন কবি রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও আলোচনা করে সভা গরম করে রাখত পশুপতি। (চলবে...)

No comments

Powered by Blogger.