Header Ads


 

ছেলেবেলা : ২ (দ্বিতীয় পর্ব) - বন্দিতা রায়

ছেলেবেলা : ২ (দ্বিতীয় পর্ব)

বন্দিতা রায়

(ঝরঝরে বাংলা গদ্যে অনবদ্য স্মৃতিচারণ...)

 

বিদ্যালয়ের ঘর ছিল। দরজার পাল্লা সব ঘরে ছিল না, জানলা তো নয়ই। একটি ঘরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী, ভাঙা বেঞ্চিতে বা পাটায়। প্রথম শ্রেণী যে যার ঘর থেকে নিয়ে যাওয়া আসনে। কারো নাম পদবী নিয়ে মাস্টার মশাইরা ডাকতেন না, চল ছিল না। যেমন আমার নাম ছিল খুকি। বাড়িতে কিন্তু আমার দিদির ঐ নাম। এছাড়াও বুড়ি, বড় বুড়ি, ছোট বুড়ি ইত্যাদিও ছিল। ছেলেরা এতটা বঞ্চিত ছিল না। তবে তাদের ঘরের নাম ধরেই ডাকা হতো।

বিদ্যালয়ে ঘণ্টা ছিল না। তাই কোনদিন ঘণ্টা পড়েনি। রাস্তার ধারে বিদ্যালয়। তাই বাস গেলে সময় বোঝা যেত। ঘড়ি কারো ছিল না। দ্বিতীয় ঘরে চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণী। দুই শ্রেণীতেই একজন পণ্ডিত মশাই পড়াতেন। এই ঘরটার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে সেটাতে একটা বোর্ড দেওয়ালে টাঙানো ছিল এবং পণ্ডিত মশাইয়ের চেয়ারটা আস্ত ছিল। পড়াশুনাটা খুব গুরুতর ছিল, কারণ শাস্তির বহরটা খুব বেশি ছিল। যেমন হাতে ছড়ি মারা। ঘুসিম গুটির উপরে হাঁটু রেখে নীল ডাউন হওয়া। কান মলা খাওয়া, পেটের চামড়া টেনে ধরা, চুল টানা ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াতেন মেজ পণ্ডিত, তাঁর চেয়ারটার একটা হাতল ভাঙা। প্রথম শ্রেণীতে পড়াতেন ছোট পণ্ডিত, তাঁর চেয়ারের একটাও হাতল ছিল না। তাঁর হাতের ছড়িকে এবং তাঁকেও সবাই ভয় পেতাম। গণিত, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, স্বাস্থ্যবিধি পড়ানো হতো। নিচু ক্লাসে প্রত্যেকদিন ছুটির আগে নামতা ডাকতে হতো। নামতা মুখস্ত না হলে শাস্তি পেতে হতো। দ্বিতীয় শ্রেণীতে কড়াকিয়া, বুড়িকিয়া, পণ, কাঠা ইত্যাদি শিখতে হতো। বই ছিল ধারাপাত। গোলাপি রঙের লম্বা পাতলা বই। কিন্তু গুরুত্ব ভীষণ। ক্লাস থ্রি-তে সের, মন, মানসাঙ্ক ইত্যাদি পাঠ্য ছিল। সে যারা পড়েছেন তারাই জানেন তার রস।

প্রতি ক্লাসেই প্রথমে গণিত পড়ানো হতো। তারপর সাহিত্য, তারপরে যে কোন বিষয়। প্রত্যেকদিন খাতা দেখে নাম ডাকার ব্যাপার ছিল না। আমরা সবাই আমাদের ভালো নাম জানতাম না। পরীক্ষার সময় অনেকের বাড়ির অভিভাবকেরা এসে উত্তর বলে দিতেন। আমি দাদুকে বললাম, তুমি চল, আমাদের বলে দেবে। দাদু খুব বকলেন। আমাকে নিজেই লিখতে হল। কোন কোন অভিভাবক, ‘দেখি খুকি কী লিখছ’ বলে তাদের বাড়ির ছেলে মেয়েদের বলে দিতেন। তবুও আমরা অনেক শিখেছি। এর থেকে বেশি শেখার ব্যবস্থা, পরিবেশ এবং প্রয়োজন ছিল না বোধহয়। শৃঙ্খলাটা খুব বেশি ছিল। যেমন ধুতি পরা বাঁকা যখন পড়া বলতে পারত না তখন আমারই বেশি ভয় পেত। পড়াটা আমার জানা, এবং তার পরের স্টেজেই বেঞ্চির উপর উঠে তার কান মুলে দেওয়া। সে বড় ভয়ঙ্কর। ছুটির পর রাস্তাতে বেরোলেই তার চপেটাঘাতে আমার মুখ বেগুনি। কানের পাশ ঝাঁ ঝাঁ। তার উপর হুঙ্কার। পণ্ডিতেরা একটু রসে বশে চলতেন। যেমন বাঁকাকে বলতেন- ‘তুই তাঁতই বুন। তোর লেখাপড়া হবে নি।’ এই রকম যার যা পারিবারিক পেশা তাকে তাই করার উপদেশ দিতেন। আবার কামাই করলেও প্রহার।

বিদ্যালয়ে গেলে তো ‘সাথি, সেথো’ বাড়বেই। কিন্তু আমার খুব বাড়ল না। কারণ আমি গুটি বা কড়ি খেলতে পারতাম না। তাই আমাকে মেয়েরা নিত না। আমি গুটি খেলার চালগুলি পরপর মনে রাখতে পারিনি। তার অনেক কসরত ছিল, হাত উপুড় করে, সোজা করে ইত্যাদি। সব দেখছি ভুলে বসে আছি। আসলে খেলতে নিত না তো, পাশে বসে দেখা। আর ছিল ‘বাঘ-ছাগল’ খেলা। ওটা পারতাম। মেয়েদের মন জয় করতে বকুলের মালা গেঁথে দিতাম। ছেলেরা খেলত হাডুডু, লং জাম্প ইত্যাদি যা বেশিরভাগ দিনই মারপিটে শেষ হতো। আমি ওদের সঙ্গী ছিলাম। সোমবার সব ঋতুতেই সকালে স্কুল ছিল, কারণ ঐ দিনটা ছিল হাট বার। শিক্ষকরা বাড়ির খোঁজ খবর রাখতেন, তাই জিজ্ঞাসা করতেন কার বাড়িতে কী চাষ হয়েছে, কী কী নিয়ে হাটে যাবে।

স্কুল পরিদর্শক যেদিন আসতেন সেদিন সব বিষয়েই সবাই যথাসাধ্য পরিপাটি আসত। স্কুলে জুতো পরে কয়েকদিন গিয়েছিলাম। কেউ পরে না, আমার কেমন অস্বস্তি হতো। তার পরে ক্রমশ খালি পায়ে হাঁটা অভ্যেস হয়ে গেল এবং বেশ আরাম হল। মাতৃদেবী বাড়িতে গজগজ করতে লাগলেন। (চলবে…)

No comments

Powered by Blogger.