প্রেম এবং নিহত গোলাপেরা - দিলীপ কুমার মাইতি
প্রেম এবং নিহত
গোলাপেরা
দিলীপ কুমার মাইতি
[বর্তমান সংশোধনাগার কর্মী হিসেবে নানান ধরণের অপরাধীদের সঙ্গে কাজ করতে হয় লেখককে। ফলে স্বভাবতই মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া কত বিচিত্র ঘটনার সাক্ষী হতে হয় তাঁকে। অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকেই জীবনের গল্প লেখেন দিলীপ কুমার মাইতি।]
গ্রামের
এক মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান শোভন যখন দু’দুটো পাশ দিয়ে তৃতীয় পাশের আশা নিয়ে
কলেজে উপস্থিত হল তখন গ্রামে তার প্রশংসার জোয়ার উপচে পড়ল। তার ওপর সকলের নজরকাড়া চেহারা
শোভনের। কলেজের অনেক মেয়েই তার সান্নিধ্য কামনায় সচেষ্ট। তবুও শোভন তাদের ধরাছোঁয়ার
বাইরে রয়ে গেছে।
আসলে শোভন
গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের বলে সে এক মাঝারি ধরণের মেসে থাকত। এই মেসের রাঁধুনি স্বামী
পরিত্যক্তা এক মহিলা। কিন্তু বয়স কম। সুঠাম, সুগঠিতা, সৌন্দর্যময়ী নারী। সর্বাঙ্গে,
কথাবার্তায়, আচার আচরণে অনুপম আবেদনের অধিকারিণী। নাম পূর্ণিমা। শোভন এরই আবেদনে সাড়া
দিয়েছিল। ক্রমে উভয়ের মনে আসক্তি জন্ম নেয়। ছুটির দিনগুলিতে মেসের আর সকলের অনুপস্থিতিতে
তাদের দুজনের মধ্যে ‘বিয়ের আগে বাসরের কাজ’ সারা হয়ে যায়। প্রকৃতির নিয়মে শোভন ও পূর্ণিমার
অবৈধ প্রেমের ফসল হিসেবে পূর্ণিমার জঠরে আসে এক নিষ্পাপ শিশু। একথা জানতে পেরে শোভন
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। একদিন সকলের অলক্ষ্যে সে মেস ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়।
কিছুদিন
বাদে পূর্ণিমার শিশু সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে। সে তখন এক আদর্শ মায়ে পরিণত হওয়ার চেষ্টা
করে। শোভনের নামানুসারে ছেলের নাম রাখে সুশোভন। কিন্তু সমাজ তাকে টিকতে দেয় না। তার
দুর্ঘটনা নিয়ে চারিদিকে নানা রটনা ছড়িয়ে পড়ে। তাকে অনেক অপমান, অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা
সইতে হয়। মেসে তাকে রান্নার কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। নিয়তির নির্মম পরিহাসে ঐ মেসেরই
এক ছেলে গোপনে তাকে শোভনের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা জানিয়ে দেয়।
পূর্ণিমার
বাঁচার দুরন্ত আশা ও আবেগ তাকে এগিয়ে নিয়ে চলে। শিশু সন্তানকে সযত্নে বুকে ধরে বেরিয়ে
পড়ে শোভনের খোঁজে। দীর্ঘ বাস যাত্রার পর নেমে রিক্সায় রওনা দেয় সে। যেতে যেতে সে ভাবে
শোভনের দেখা পেলে সে তার আশ্রয়স্থল পাবে। হয়তো শোভন আনন্দে অধীর হ্যর উঠবে। হারানো
প্রেমকে ফিরে পেয়ে সাদরে বরণ করে করে নেবে। আবার তার মনে সংশয় জাগে – শোভন যদি তাকে
গ্রহণ না করে! যদি বলে তাদের সে চেনে না! তাহলে কী হবে? ভাবতে ভাবতে রিক্সা শোভনের
বাড়ির অনতিদূরে উপস্থিত হয়। উভয়ে উভয়ের প্রতি অবাক বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
উত্তাপহীন ভদ্রসন্তান শিক্ষিত শোভন পূর্ণিমাকে নিয়ে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে
যাবে বলে তখুনি রওনা দেয়। সেই দিন ছিল উল্টোরথ। বিকালে সে পূর্ণিমা ও তার শিশু সন্তানকে
নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মেলা দেখার জন্য। মেলাতে পূর্ণিমার পছন্দমতো জিনিসপত্র কিনে দেয়। শেষে
রাত এগারোটা নাগাদ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কাজু বাদাম বনের মধ্য দিয়ে কেয়া বেড়ার
দ্বারা বেষ্টিত এক সঙ্কীর্ণ বালি রাস্তা ধরে। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে পড়ে পূর্ণিমা। বিশ্রাম
নিতে বলে শোভনকে। শোভন তখন তাদের নিয়ে উপস্থিত হয় এক জনমানবহীন গভীর জঙ্গলের মধ্যে
এক জলাশয়ের ধারে। সেখানে বিশ্রাম নিতে বলে শোভন হাত বাড়িয়ে দেয় পূর্ণিমার গলার দিকে।
সজোরে টিপে ধরে তার গলা। একটি নিমেষেই পূর্ণিমা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাচ্চাটিকেও
একইভাবে শেষ করে দেয়। শেষে পূর্ণিমাকে তার পরনের কাপড় গলায় বেঁধে ঝুলিয়ে দেয় গাছের
ডালে। শিশুটিকেও দড়ি বেঁধে পাথর ঝুলিয়ে ফেলে দেয় জলে। সে মনে মনে ভাবে যে, সকালে লোক
জানতে পারলে ভাববে যে মেলা থেকে ফেরার পথে দুষ্কৃতকারীরা মেরে ফেলেছে। কিংবা সে আত্মহত্যা
করেছে।
পরের দিন
দুপুর নাগাদ মানুষ জানতে পারে। কিন্তু কে এই মেয়ে? কেউ মেরে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে, নাকি
নিজেই আত্মহত্যা করেছে তা কেউই নির্ধারণ করতে পারে না। বিভিন্ন লোকে বিভিন্ন ধরণের
আশঙ্কা করে। থানা-পুলিস হয়ে যায়। অবশেষে পুলিস কুকুর হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে সক্ষম
হয়। পুলিস শোভনকে গ্রেফতার করে। সুশিক্ষা ও সৌন্দর্যের অধিকারী শোভন সমাজের চোখে চিহ্নিত
হয় একজন শয়তান ও খুনি হিসেবে। আদালতের বিচারে তাকেও একদিন ফাঁসির দড়িকে বরণ করে নিতে
হয়।
No comments